কোরকের কথা
১৯৭৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। লম্বা ছুটির অবসরে বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠ স্কুলের পরীক্ষার্থী কয়েকজন কিশোর ভাবলো একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করলে কেমন হয়? যেমন ভাবনা সেইমতো কিছু কিছু লিখে ফেলাও হলো। তারপর স্কুলের হেডমাস্টার শ্রী অনুপ ঘোষ মহাশয়ের কাছে গিয়ে বিষয়টা জানাতেই তিনিও বেশ উৎসাহ দিলেন। পত্রিকা বেরোলো এবং হেডস্যার নোটিশ বোর্ডে সে পত্রিকা টাঙিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন। স্কুলের শিক্ষকরা পত্রিকাটা পড়ে বললেন বেশ ভালোই হয়েছে। একজন মাস্টারমশাই, সকলের প্রিয় স্যার শ্রী অমরকৃষ্ণ বসু, ছেলেদের উৎসাহ দেখে তাদের পরামর্শ দিলেন পত্রিকাটা বই হিসেবে বের করতে। দেওয়াল পত্রিকা স্বল্পায়ু। বই না হলে পুরোনো সংখ্যার লেখাগুলো হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য। মাস্টারমশাই চেনা প্রেসের ঠিকানা দিতেই দলবেঁধে ছেলেরা চললো কলেজস্ট্রিট। বই আকারে পত্রিকা বের করতে হবে এবার। লেখাগুলো দেখে প্রেস থেকে বলা হলো - এটুকুতে হবে না। বাড়াও। আরো লেখো। অন্তত ৩২ পাতা তো হওয়া চাই।
পত্রিকার নাম যদিও আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দিয়েছিলেন সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কিশোরদলের একজনের দাদা। বলেছিলেন তোমরা তো এখন সবে ফুটে উঠছো। তোমরা কুঁড়ি। তোমাদের পত্রিকার নাম হোক কোরক।
৭৭ সালের যে দেওয়াল পত্রিকা কোরক কয়েকজন উৎসাহী মাধ্যমিকের ছাত্র আর মাস্টারমশাইয়ের পরামর্শে প্রথম বই হয়ে বেরোলো তা আজ মহীরুহ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লিটল ম্যাগাজিন কোরক সাহিত্য পত্রিকা। প্রথম সংখ্যার খরচ বহন করেছিলেন বোস এন্ড বোস পেপার হাউসের কর্ণধার অমর স্যারের কাকা শ্রী ফনীভূষণ বসু।
শুরুর দিন থেকে যাঁর হাত ধরে কোরক প্রস্ফুটিত হয় তিনি পত্রিকার সম্পাদক তাপস ভৌমিক। ৭৭-এর প্রথম সংখ্যার কোরক পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন "শরৎ সাহিত্যে কিশোর চরিত্র" বিষয়ে। সমবয়সী সঙ্গী, বন্ধুদেরও হতেখড়ি হয়েছিল এই সংখ্যায়- কেউ লিখেছিলেন কবিতা, কেউ ভ্রমণকাহিনী বা প্রবন্ধ - নিবন্ধ।
লবণহ্রদ বিদ্যাপীঠের বাংলা সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক তাপসবাবুর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছিল পত্রিকার শুরুর দিনগুলোর কথা।
বেশ কিছু সংখ্যা বেরোনোর পরে ঠিক হয় পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। আলিপুরে অফিস আছে খোঁজ পেয়ে, যাওয়া স্থির হয়। সব শুনে আধিকারিক ফর্ম দিয়ে ফিলাপ করে আনতে বলেন। ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে কিছু চুক্তি ও ঘোষণার ব্যাপারও ছিল।
কোরকের সাথীরা তখন সবে সবে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনোর প্রবল চাপ। পত্রিকা রেজিস্ট্রেশন অফিসের আধিকারিক ব্যাপারটা কিন্তু বুঝেছিলেন যে তিন মাস অন্তর পত্রিকা বের করতে ছেলেগুলোর বেশ কষ্ট হবে পড়াশুনোর মাঝে। তিনি পরামর্শ দিলেন - তিন মাস নয়, তোমরা পত্রিকা করো চতুর্মাসিক। স্ট্যাম্প পেপার তোমাদের কিনতে হবে না। ওটা আমিই দিচ্ছি। আর ফর্মে এখানে তিনটে নাম দাও দেখি। প্রথমটায় যদি অন্য কোনো রেজিস্ট্রেশন থাকে তবে সে নাম তোমরা পাবে না।
আলিপুরের অফিস থেকে দিল্লিতে তিনটে নাম যায়। ১. কোরক, ২. কোরক সাহিত্য পত্রিকা, ৩. কুসুম কোরক। শেষ অবধি "কোরক সাহিত্য পত্রিকা" নামে পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন হয়।
এরপর থেকে কোরক পেরিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। পাশে দাঁড়িয়েছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অলোক রায়, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যর মত শিক্ষাবিদ, লেখক।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাশে থেকেছেন। শঙ্খ ঘোষ প্রুফ দেখে ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। কোরক সাহিত্য পত্রিকার প্রতি সংখ্যাই পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এখনও হয়। কিন্তু কিছু বিশেষ সংখ্যা পাঠকমনে দারুণ ভাবে দাগ কেটে গিয়েছে। সে সব সংখ্যা পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে পরে কোরক প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সংকলন।
তাপস ভৌমিক আজ পত্রিকা তথা এক ঝাঁক তরুণ লেখকের অভিভাবক। তাঁর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর ভালোবাসায় কোরক সাহিত্য পত্রিকা আজও বাংলা সাহিত্যকে ও পাঠকদের সমৃদ্ধ করে চলেছে।
(কোরক সাহিত্য পত্রিকার কিছু দুষ্প্রাপ্য সংখ্যা ও সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইগুলি সংগ্রহের জন্য আমি ও কৌশিক রায় দা কোরক পত্রিকার দপ্তরে হানা দিয়েছিলাম (৫ মে, ২০২৪)। সম্পাদক শ্রী তাপস ভৌমিকের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছিল পত্রিকার শুরুর দিনগুলোর কথা। উপরের লেখাটি তার ভিত্তিতে অনুলিখিত।
কোরক পত্রিকার একটি ওয়েবসাইট করার অনুমতি আমি সম্পাদকের থেকে পেয়েছি। অদূর ভবিষ্যতে এতে পত্রিকার পুরোনো, দুষ্প্রাপ্য সংখ্যার ডিজিটাল আর্কাইভ ও নতুন সংখ্যা, কোরক সংকলন ও প্রকাশনার অন্যান্য বইয়ের হাল-হদিস জানানো হবে ও দূরের পাঠকদের জন্য সুলভে বই পাঠনোর ব্যবস্থাও করা হবে।)
দিব্যেন্দু সিংহ রায় (০১/০৭/২০২৪)
.jpg)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন