পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)
শুরুর কথা:
লেখক পরিমল ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে আমার পরিচয় বছর চারেক আগে। কুড়ি সালের মার্চে লকডাউন শুরুর ঠিক আগের দিন কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদে আমার তখনকার ঠিকানায় শেষ বারের মত কয়েকটা বই পৌঁছয়। তারই একটার নাম "ড্যাঞ্চিনামা - একটি স্মৃতির প্রত্নসন্ধান"। ভেবেছিলাম বাঙালি বাবুদের পশ্চিমে হাওয়া বদল নিয়ে একটা তথ্যবহুল বই পড়তে চলেছি। কিন্তু পড়ে সে ভুল ভাঙে। সেদিন মনে হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের এক দুর্দান্ত লেখক আর লেখনীকে খুঁজে পেলাম। আজ মনেহয় বইটা পড়ে লেখক নয় যেন নিজেরই এক আলাদা পাঠকসত্বা কে আবিষ্কার করেছিলাম। আলাদা ভাবে আলোচনার দাবী রাখে সে বই। সে আলোচনা সঠিকভাবে করতে গেলে পাঠককে মুগ্ধতার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। পরিমলবাবুর লেখা পড়ে আজ অবধি এই মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাঁর লেখনী তাঁর দর্শন আমাকে দারুন ভাবে আকর্ষণ করতে থাকে তাই সোস্যাল মিডিয়ায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি ও দেখা করার ইচ্ছার কথা জানাই। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু অরিন্দমকে ওনার কিছু বই পড়তে বলি। "দার্জিলিং - স্মৃতি সমাজ ইতিহাস" শেষ করে তারও তখন পরিমল বাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রবল। লেখক সম্মতি দেন কিন্তু লকডাউন তখনও কাটেনি। আমারা একটা একটা করে তাঁর অন্যান্য বইগুলো পড়তে শুরু করি আর এমন এক বাস্তবকে অনুভব করতে থাকি যা আমাদের খুব কাছে থেকেও যেন ধরা ছোঁয়ায় বাইরে। কিছুতেই আর পাঠক রইলাম না তারপর। কিভাবে যেন তাঁর ভক্ত হয়ে পড়লাম।
অনেক সংকোচ কাটিয়ে যখন অবশেষে চার বছর পর পরিমল বাবুর সঙ্গে দেখা হলো; তাঁর অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন করে আমাদের উপস্থিতির কথা জানালাম তখন আমি উত্তেজনায় কাঁপছি। অরিন্দম দা ব্যাপারটা আগে থেকেই আঁচ করেছিল। তার পরামর্শ ছিল এভাবে হুট করে গিয়ে ওনার সময় নষ্ট না করে বরং তুমি কিছু প্রশ্ন ঠিক করো। চেষ্টা করো যাতে ওনার লেখা আর লেখার পেছনের দর্শন সেই প্রশ্নের উত্তরে উঠে আসে। সেই মত আমরা কিছু প্রশ্ন পরিমল বাবুকে করেছিলাম। মুগ্ধতা সরিয়ে রেখেই চেষ্টা করেছিলাম প্রশ্নগুলো সাজাতে তবে কোনো ফরমাল ইন্টার্ভিউ নয়। আড্ডাই চলছিল সিঙ্গারা আর কফি খেতে খেতে। মৌলানা আজাদ কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের অফিস ঘরে দুঘন্টা কাটিয়ে আমরা যখন ফিরে আসছি তখন গুমোট মেঘ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়েছে শহরে। আমাদের মনেও।
আড্ডার ব্যাক্তিগত আনন্দময় অনুভূতিগুলো নিজদের কাছেই থাকে যাক। নানা প্রশ্ন আর তার উত্তরে লেখক কি বললেন তা সবার জন্য রইলো।
এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমরা আপনার সামনে বসে আছি।
আরে! দেখা করা কি এমন ব্যাপার। আসলে আমি সামাজিক অনুষ্ঠানে পারতপক্ষে যাই না। সাহিত্য সভা, অনুষ্ঠান ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর হয়। আমার সে নষ্ট করার মত সময় নেই। আজকাল সবাই সেটা জেনে গেছে। একটা সময় অবধি আমার কোনো পাঠক দেখা করতে চাইলে আমি ডিসকারেজ'ই করতাম। পরের দিকে মনে হলো আমিই হারাচ্ছি। কারণ এইভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে... পরে তাদের অনেকের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এবং আমি পাই। যারা দেখা করতে আসে তারা বেশিরভাগই ইয়ং। বেশ সিরিয়াস পাঠক। আর এমন সাহিত্যবোধ সম্পন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে আমার ভালই লাগে। একেবারেই কোনো ব্যাপার নয়। আমারও অনেক জানা হয়।
আপনার লেখালিখির শুরু কিভাবে? কখন ভাবলেন লিখতে হবে? কোন ব্যাপারগুলো আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়?
আমি লেখালিখি, মানে বই লেখা শুরু করেছি একটু পরে। যদিও সাহিত্য, লেখালিখি করব এই ভাবনাটা কলেজ জীবন থেকেই। কবিতা টবিতা লিখতাম। ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হতো। আমাদের নৈহাটি অঞ্চলে অনেক লিটিল ম্যাগাজিন বের হতো। সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার পরিমন্ডল ছিল অনেক দিন ধরেই। নৈহাটিতে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু... । এইযে সমরেশ বসুকে নিয়ে এত চর্চা হচ্ছে এখন..., ১০০ বছর। একজনের নামই কেউ করছে না। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নৈহাটি সিনে ক্লাব। খুব পুরোনো। ১৯৬৪ এর। আমি কলেজ জীবন থেকে ওখানে সিনেমা দেখতাম। নৈহাটিতে চর্চার একটা পরিবেশ ছিল খুব পুরোনো। হাইয়ার সেকেন্ডারি থেকে কবিতা লেখা .. যা হয় আরকি সংস্পর্শে এসে লিটিল ম্যাগাজিন, কবিতা। তারপর দার্জিলিং চলে গেলাম কাজ নিয়ে। সেখানে অন্য রকম পরিবেশ। লেখা বন্ধ হয়নি। তখন কাগজ টাগজে লিখতাম। টেলিগ্রাফে লিখতাম মেইনলি। তার বেশ কিছুদিন পরে আমার দার্জিলিং বইটা লেখা শুরু হলো।
বাংলা বইয়ের পাঠকদের নিয়ে আপনার কি ধারণা?
আমার ধারণা হয়েছিল যে বাংলা সিরিয়াস লেখা তেমন কেউ পড়েন না। এসব লেখার তেমন পাঠক নেই। তারপর কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই একটা লেখা বারোমাস পত্রিকার পাঠালাম। সেটা বড় করে বেরোলো। দার্জিলিং নিয়ে তখন রাজ্য বেশ অশান্ত। বারোমাস পত্রিকার সম্পাদক, অশোক সেন, পড়ে আমাকে ফোন করলেন। বুঝলাম, না এই লেখাগুলোর পাঠক আছে। এটা আমার কাছে একটা আবিষ্কার। সত্যিই ভাবিনি, আমি যে ধরনের লেখা লিখি তার এত পাঠক আছেন। এত সিরিয়াস পাঠক আছেন। পাঠক এত দিনে যা পেয়েছি সেটা কম নয়, এবং তা বাড়ছে। এটা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়ের। নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করি। ইংরেজিতেও লিখছি এখন কিন্তু বাংলার পাঠক আমার কাছে একটা বড় ব্যাপার। খুব কৃতজ্ঞ বোধ করি যে লোকে আমার বই পড়ে। অনেকেই বলেন বাংলায় সিরিয়াস পাঠক কই । কিন্তু একেবারেই তা নয়। একটা উদাহরন দি - মনীন্দ্র গুপ্তের "অক্ষয় মালবেরি" অবভাষ অখন্ড সংস্করণ বের করার পর গত দশ বারো বছরে বারো তেরোটা সংস্করণ বেড়িয়েছে। দুটো এডিসনের মধ্যে গ্যাপ ক্রমশ কমছে। অর্থাৎ এত পাঠক আছে এই বই পড়ার। আমি তো খুব আশাবাদী বাংলার পাঠকদের নিয়ে।
এখন আপনি কি নিয়ে লিখছেন? ইংরেজিতে না বাংলায়?
এখন হার্পার কলিন্স আমার বইগুলো ছাপছে। ওদের সঙ্গে আমার কনট্র্যাক্ট, আমার সব লেখা ওদের প্রথমে দেখাতে হবে। ওদের সঙ্গে বনিবনা না হলে তবে অন্য জায়গায়। ওরা বেশ চাপও দিচ্ছে। কিন্তু এখন আমি বাঙলাতেই একটা উপন্যাস লিখছি। এটাই অনেক জরুরী মনে হচ্ছে আমার কাছে। অনেক বড় লেখা এটা।
এটাকি যে খন্ড উপন্যাস অনুষ্টুপে প্রকাশিত হয়েছিল সেটাই?
হ্যাঁ।
এটা কি আপনার প্রথম উপন্যাস?
(কিছুটা ভেবে) হ্যাঁ। এটাকে আমি লুকোছাপা না করে ফিকশন বলছি। আগের যে আমার লেখাগুলো তাতে অনেক ফিকশনাল এলিমেন্ট আছে। এমন কোনো উপন্যাস নেই যাতে নিজের কথা বা নন ফিকশন নেই; এটা যেমন সত্যি তেমনই সব নন-ফিকশনেই কিছু না কিছু ফিকশন থাকে। কিন্তু এটা একেবারেই ফিকশন। হ্যাঁ, সেই অর্থে প্রথম।
উমম... প্রথম একদম বলবো না। নব্বইয়ের মাঝামাঝি যখন আমি দার্জিলিঙে ছিলাম তখন একটা ইংরেজি উপন্যাস লিখি। তখন ভারতে পেঙ্গুইন ছাড়া ইংরেজি পাবলিশার তেমন ছিল না। পেঙ্গুইনে লেখাটা পাঠালে তারা বেশ উৎসাহ দেখালেও অনেক বদল টদল করতে বলে। আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এখন যেটা লিখছি বাংলাতে সেটাই আমার প্রথম।
আপনি আপনার বইতে যাদের কথা বলেছেন তাদের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে? যেমন ধরুন বেনসন কুঞ্জু কুঞ্জু যার কথা আপনি দার্জিলিঙে লিখেছিলেন।
বেনসন কুঞ্জু কুঞ্জু নামে কিন্তু কেউ ওভাবে নেই। ২০১৯ সালে আমি একটা অনুষ্ঠানে দার্জিলিং গেছিলাম। তখন এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। ঠিক এই নামে কেউ নেই বা ওই কলেজে ওই নামে কেউ নেই কিন্তু এমন মানুষ ছিলেন যাদের আমি দেখেছি। আমার এক মালায়ালি বন্ধু আছে। তিনি দার্জিলিঙে ছিলেন কিছুদিন। যদিও আমি থাকাকালীন তিনি ছিলেন না। বইতে বলা এডস এর ব্যাপার স্যাপার তাঁর নেই। আসলে হয় কি, অনেকগুলো জিনিস জুড়ে একটা চরিত্র তৈরি হয়। আর সে সময়ে দার্জিলিঙে এডস এর প্রকোপ ছিল খুব। এডস এর কথা এখন তেমন শোনা যায়না। কিন্তু তখন ভয়ানক ভাবে... আর দার্জিলিঙে আগ্নেয়গিরির মত এডস এর বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছিল। জানিনা এখন কোন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটা চরিত্র একদম বাস্তব তা নয়। একটা চরিত্রের মধ্যে একাধিক চরিত্র। কারোর কারোর সাথে যোগাযোগ আছে। যেমন হেমরাজ ছেত্রী নামে একজন। ওই নামে নয় অন্য নামে ছিল। এখন বিদেশে আছে। ছাত্র ছাত্রীদের কথা লিখেছিলাম। তারা অনেকেই ওখানে প্রতিষ্ঠিত। তাদের সাথেও যোগাযোগ আছে অল্পবিস্তর।
অপুর দেশ বইতে আমরা অনেক প্রান্তিক মানুষের কথা পড়েছি। গ্রামের মানুষ। অতি সাধারণ মানুষ যারা চাষি , জেলে বা একজন অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাঁদের কথা লিখলেন অর্থাত্ তাঁদের সাথে আপনাকে বেশ কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। ওঠাবসা করতে হয়েছে। আপনি যথেষ্ট শহুরে মানুষ। তাঁরা কি মন খুলে নিঃসঙ্কোচে একজন শহুরে, উচ্চশিক্ষিত মানুষের কাছে তাঁদের কথা বলতে পারতেন? তাঁরা কিভাবে আপনাকে গ্রহণ করতেন? বা আপনিই বা কিভাবে তাদের সাথে কথা বলতেন?
আমরা যতই বলি মাঠে ঘাটে গিয়ে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে যাব, তা সহজে হয়না। আমার চেহারা, আমার উচ্চারণ, কথা বলার ধরন, সেগুলো এক নয়। যদি তাঁদের পাশে, মাঠে ঘাসের উপর চটি খুলে বসি তাহলে আমার পা আর একজন কৃষকের পা... বিরাট পার্থক্য থাকে। কিন্তু আমার ইন্টারেস্ট যদি জেনুইন হয়, মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি এবং কোথাও যদি সেই মানুষটার প্রতি আগ্রহ ও সম্মানবোধ থাকে তবে; যেটা খুব মিসিং আমাদের চারদিকে, তাহলে মানুষের সাথে অনেকটা একাত্ম হওয়া যায়। সেটার জন্য সবসময় যে তার জগৎ, তার শ্রেণীর মানুষ হতে হবে তার কোনও মানে নেই। অনেক সময় বরং অন্য জগতের মানুষের কাছে আমরা দ্রুত মন খুলে ফেলি। কারণ আমরা জানি দুটো গ্রহ আমরা হঠাৎ নিজস্ব কক্ষপথে একজায়গায় এসে আবার দূরে চলে যাব। তাই নিজের কথা বললে কিছু যাবে আসবে না। সমস্যা হবে না। পাশের বাড়ির লোকের সাথে কথা বলার সময় আমরা বরং অনেক ভেবেচিন্তে বলি। এবং আমার সৌভাগ্য বলতে পারো যে এমন মানুষের সাথেও আমার তাড়াতাড়িই একাত্মতা তৈরি হয় যার সাথে আমার কোনো মিল'ই নেই। অসুবিধা হয়না।
গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো আমি যে খুব পারপাসফুলি করেছি তা নয়। কেবল ঘোরার আনন্দে ঘুরেছি। এখন আর সেভাবে হয়না ঘুরে বেড়ানো, সময়ের অভাবে। তবে একবারে হয়না এমনও নয়। সম্প্রতি ইউরোপ গেছিলাম। প্রায় একমাস ধরে আটটা দেশ আর বারোটা শহরে ছিলাম। অনেকটাই একা। প্রথম দিকে বার্লিনে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তারপর আমি একা ঘুরেছি কেবল ওই ঘোরার আনন্দে। শেষের দিকে আমার স্ত্রী এসেছিলেন। আগে এটা খুবই করতাম। আমার একজন বন্ধুর কথা সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছিলাম। বেশিরভাগ তার সাথেই। একটা স্কুটারে করে আমি আর সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরেছি। কালনা অবধি চলে গেছি। এভাবে ঘোরাঘুরি আমি অনেক করেছি। সেগুলো সবই জমেছে। তারই এক্সটেনশন কিছু এসেছে আমার লেখায়।
( চলবে ....)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন