স্মৃতি
ঃঃ এক ঃঃ
১৯৮১ সালের এক বিকেল বেলায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পূজো দিতে গিয়ে আমার বাবা খেয়াল করে যখনই সে ধূপকাঠি জ্বালাতে যাচ্ছে তক্ষনি দমকা হাওয়ায় আগুন নিভে যাচ্ছে বারবার। বহুবার চেষ্টাতেও যখন ধূপ জ্বলল না তখন পূজো না দিয়ে অজানা দুর্ভাবনা নিয়ে উত্তরপাড়ায় ফিরে আসার পর বাবা জানতে পারে তার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। সেখান থেকে বাবা যখন বাড়ি পৌঁছায় তখন দাদুর দাহকার্য হয়ে গিয়েছিল।
শেষবার আর দাদুকে দেখা হয়নি বাবার। এসব আমার জন্মের প্রায় ৮ বছর আগের কথা। একটা ছবি ছাড়া দাদুকে আমি দেখিনি। পলাশী বাজারের মধ্যে দাদুর একটা চায়ের দোকান ছিল। সে দোকান আজও আছে। সৎ , কর্মঠ মানুষ হিসাবে দাদুর নাকি বেশ সুনাম ছিল। লোকে মন্যি গন্যি করতো। কষ্ট করে ভাইদের বড় করেছিল। এসব কথা যখন বাবা বলে তখন আজও তার গলা উদাস হয়ে যায়। চোখ ছলছল করে।
আমার ছোটদাদুকে যদিও আমি দেখেছিলাম। মাথার মাঝে মস্ত টাক। বয়সের ভারে একটু কুঁজো হয়ে গেলেও চলাফেরা করতেন যথেষ্ট। যে সময় আন্দামানে বনজঙ্গল কেটে আবাদ করা হচ্ছে সে সময়ে ছোটদাদু ছিলেন সরকারি সার্ভে টিমের সদস্য। তার ঝুলিতে ছিল দুর্গম আন্দামানের নানা সম্ভব অসম্ভব রহস্যে ভরা গল্প। আর ছিল বনজঙ্গল, দলের লোকজন , জড়োয়াদের সাদাকালো ছবি।
ছোট দাদুর গল্পগুলো আমরা কখনো তার মুখে কখনো বাড়ির অন্যান্যদের মুখে শুনেছি। শুনেছি দাদু আর ছোটদাদুর মধ্যে যে চিঠি দেওয়া নেওয়া হতো তা নাকি চিঠি লেখার উদাহরণ হিসাবে বাঁধিয়ে রাখা যায়। ছোট্ট একটা পোস্টকার্ডে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে দাদু সংসারের যাবতীয় খবর ছোটদাদুকে পাঠানোর পরেও তার কুশল সংবাদ নিতে ভুলতেন না।
ছোটদাদুও আজ নেই।
সংগ্রাহকরা একটি সাধারণ বস্তুর উপর স্মৃতির ভার বড় ভালো বোঝেন। বোঝেন তার ভবিষ্যতের মূল্য। আমরা সংগ্রাহক নই। ঘর পরিষ্কারের সময় তেমন দুএকটা চোখে পড়লেও সেসব ছবি, চিঠি আমরা বাঁচিয়ে রাখিনি। সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের স্থান সংকুলানে সেসব প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া জিনিস আগলে রাখা আসলে বিলাসিতার নামান্তর ছিল।
দাদুদের অস্তিত্ব এখন শুধু দলিলের কাগজে , ইলেকট্রিক কানেকশনের মান্থলি বিলে, আমাদের কিছু দেখা কিছু শোনা স্মৃতিতে আর বাবা জ্যাঠার গভীর, উদাসী মনের ব্যথায়।
ঃঃ দুই ঃঃ
এক পুরনো দলিলে রাধারানী রায় নামে একজন মহিলার নাম পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু হাজারবার স্মৃতি হাতড়েও সেই প্রাচীনা কে, তা জানা যায়নি। কোনও এক কালে প্রথমে পঞ্চভূতে বিলীন হল তার শরীর। তারপর ধীরেধীরে উবে গেল তার প্রভাব, স্মৃতি। হয়তো সন্তান সন্ততিও। শুধু একটি সরকারি কাগজে আটকে রইলো তার নাম।
১৮ বছর আগে চলে যাওয়া আমার মেজোজেঠুর, তারও বছর তিনেক আগে প্রয়াত ঠাকুমার স্থান আমাদের স্মৃতি আর ফ্যামিলি এলবামের গুটি কয়েক ছবিতে।
পরিবেশ, সমাজ তাদের প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে নিশ্চয়।
- বাবা তুমি তোমার দাদুর নাম জানো ?
- রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ রায়।
- লোকটা কেমন ছিলেন? দেখেছো ?
- না। আমার জন্মের আগেই .. ভালো লোকই ছিলেন নিশ্চয়। আমার বাবা তো খুবই ভালো মানুষ ছিল।
বহতা স্মৃতিও এভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে ধীরে ধীরে।
১৩৯ কোটির দেশ ভারতবর্ষে ২ কোটি মানুষ যদি খেলোয়াড় , অভিনেতা , নেতা, সমাজসেবী , ব্যবসায়ী , রাজনীতিবিদ , সাহিত্যিক বলে ধরে নেওয়া হয় , যাদের কথা হয় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে দেশের ইতিহাসে অথবা হয়ে দাঁড়াবে ইতিহাসের কালিমাময় অধ্যায়। বাকি ১৩৭ কোটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। মুছে যাবে তাদের সংগ্রাম , জীবনবোধ , আদর্শ , ভালোলাগা , ভালোবাসার গল্প ।
তাদের দেহাবশেষ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। কবরের স্মৃতিফলক একদিন মলিন অস্পষ্ট হয়ে যাবে। তাদের ভার্চুয়াল অস্তিত্ব একদিন অর্কুটের মতো দুম করে হাওয়া হয়ে যাবে। পুরনো দস্তাবেজ বাতিল হবে।
একই ভাবে একদিন ধ্বংস হবে এই সৌর জগৎ। এক কৃষ্ণ গহ্বর গপ করে গিলে নেবে আমাদের পৃথিবী। হারিয়ে যাবে আমাদের ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস , ভবিষ্যৎ, সময়ের পরিমাপ। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে কোনও এক গ্রহে তখন হয়তো অসামান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রথম এককোষী প্রাণীটি দেহ ধারণ করতে চলেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন