গল্প বলার গল্প
- একটা ভালো গল্প বলো, শুনি।
- এত গল্পের বই থাকতে আমার গল্প!
- আহ: বলো না। আস্তে আস্তে বলো। বেশ রংচং মাখিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে বলো তো দেখি। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই।
- হুম, গল্প নয় তাহলে কয়েকটা সত্যি কথাই বলি।
- না সত্যি বলতে হবে না। সত্যি সবসময় শুনতে ভালো লাগে না। গল্পই বলো।
- আচ্ছা শুনতে যাতে ভালো লাগে তেমন করে সত্যি কয়েকটা ঘটনা বলি শোনো। আজ যদি অনেকদিন পরে ঘটনাগুলো দেখি তবে মনেহবে কিছুই না, তুচ্ছ ব্যাপার সব। কিন্তু সেইসব দিনে এই ব্যাপারগুলো এমনভাবে ঘটে গিয়েছিল যে দিনের শেষে মনে হয় আর বোধয় জীবনটা না থাকলেও ক্ষতি নেই। যা দেখলাম, যা বুঝলাম তারপরে আর নতুন কিছু দেখার বোঝার থাকে না।
- দুঃখের গল্প?
- আরে না না। শোনোই না।
- সেসব দিনগুলো ছিল নতুন। গয়নার দোকান থেকে রুপোর হার কিনে আনলে দেখবে তার গায়ে একটা আস্তরণ লেগে থাকে। সেটা উজ্জ্বল নয় আবার অনুজ্জ্বলও নয়। কিন্তু সেটা দেখেই বোঝা যায় গয়নাটা নতুন। এমন নতুনের আবরণ থাকে সদ্যজাত শিশুর গায়ে। অনেকদিন অনাবৃষ্টির পর যখন প্রথম মেঘ জমে বা বেশ কয়েকদিনের দারুন বৃষ্টির পর যখন প্রথম রোদ ওঠে তখন সেই ছায়া আর আলো দিনটার গায়ে একটা নতুনত্বের আস্তরণ ফেলে দেয়। আবার কোনো কোনো দিন এমনিই কোনো কারণ ছাড়াই মনে হয় এমন আর কোনোদিন আসেনি আগে।
- আরে গল্পটা বলবে কখন?
- এইরকম করলে বলবো না।
- না না বলো বলো। একটা নতুন দিন- তারপর?
-তো এমনই একটা নতুন দিনে আমি প্রথমবার ট্রেনে চেপে ঘাটশিলা যাচ্ছি। আমাদের গ্রামে তখনও ইলেকট্রিক ট্রেন আসেনি। সিঙ্গেল লাইন। দুটো ট্রেন কাছাকাছি এলে একটাকে ষ্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড় করিয়ে অন্যটা পাস করাতে হয়। কলকাতা যেতে সময় লাগে অনেকক্ষণ।
আমি আর জেঠু সকাল ছটার ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার ধরে যাচ্ছি। নামবো নৈহাটি। সেখান থেকে ব্যান্ডেল। ব্যান্ডেল থেকে হাওড়া। তারপর ঘাটশিলার ট্রেন। দারুন আনন্দ। আমি যদিও তখন বেশ বড়। ক্লাস নাইনে পড়ি। কিন্তু ছোটোখাটো চেহারার জন্য ক্লাস সিক্সের বেশি লাগে না। ট্রেনে চেপে কলকাতা অবধি আগে কয়েকবার গেলেও নৈহাটি ব্যান্ডেল হাওড়া লাইনে সেই প্রথম।
তবুও সেই পথের একটা ধারণা আছে। কিন্তু হাওড়ার পর থেকে ঘাটশিলা অবধি কি-করে যাব, কোন ট্রেন, কোন লাইন, কতটা সময় লাগে কিছুই জানা নেই।
ট্রেনে প্রবল ভিড়, কিন্তু এক ভদ্রলোক জানলার ধারে সিঙ্গেল সিটে আমাকে তার কোলের কাছে বসিয়ে নিলেন। থামতে থামতে, চলতে চলতে নদীয়ার মাঠ ঘাট, গ্রাম, ছোট শহর পেরিয়ে ট্রেন এগোলো। কতরকম মানুষ, কি বিচিত্র তাদের গলার স্বর, জামার রং, জুতোর আকার। আর ফেরিওয়ালা। এখন যেমন ট্রেনে প্লাস্টিক বোতলের জলের হকার ওঠে। সে সময় আমাদের ওদিকে এভাবে জল পাওয়া যেত না। এক কাঁধে একটা টিনের বড় ক্যানে জল আর গলায় ঝোলানো কাঁচ দিয়ে মোরা বাক্সে মিষ্টি নিয়ে ফেরিওয়ালা উঠত। তার কাছে মিষ্টি কিনে খেলে জল পাওয়া যেত ফ্রিতে। আমিও তেমন মিষ্টি কিনে জল খেলাম। এই করতে করতে চলে এলো রানাঘাট। কামরার লোকজন গেল বদলে। নতুন লোক উঠল। ষ্টেশনগুলো সব জমজমাট। একটু পরে জেঠু একটা জায়গা পেয়ে বসে বলল - চা খাবি?
চা খেতে খেতে মাঝে মাঝেই চমকে উঠি। পাশের লাইন দিয়ে দুর্বার গতিতে আপের ট্রেন চলে যায়। উপরে ইলেক্ট্রিকের তার। জানলা দিয়ে পাশের চলন্ত ট্রেনগুলোর কামরা গোনার চেষ্টা করি। হিসেব গুলিয়ে যায় বারবার।
এই করতে করতে নৈহাটি পৌঁছে যাই। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে ব্যান্ডেল যেতে হবে। এইধরণের ট্রেনে আমি তেমন উঠিনি। ইলেকট্রিক ট্রেন, নিচু। প্ল্যাটফর্মের হাইটের প্রায় সমান ট্রেনগুলোয় সরু সরু সিট। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে চলতে যখন গঙ্গার ব্রিজের উপর পৌঁছায় তখন অনায়াসে হেঁটে তার গতি টেক্কা দেওয়া যাবে। ব্যান্ডেল পৌঁছে এবারে আরেকটা ট্রেন ধরতে হবে। এবারের ষ্টেশনের নামগুলো প্রায় সবই নতুন। তবু হুগলি, চুঁচুড়া, চন্দননগর, হিন্দমোটর, বেলুড় এই নামগুলো আগে বইয়ে পড়েছি। ষ্টেশন দেখি সেই প্রথম। এখানে লোকের কথা বলার ধরণ আলাদা, ফেরি করা খাবার আলাদা। দু এক স্টেশন যেতে যেতেই কামরার ভেতরের লোকজন পাল্টে যায় কিন্তু জানলার বাইরে শুধু বাড়ি আর বাড়ি।
হাওড়া পৌঁছে সে আরেক কান্ড। কি বিরাট ষ্টেশন। জেঠু বলল এটা নাকি শিয়ালদহর থেকেও অনেক বড়। কত প্ল্যাটফর্ম। কত দোকান। আর মানুষ মানুষ মানুষ।
দোকানে, মানুষে, ট্রেনে, শব্দে সেই বিরাট আয়োজন দেখে আমি বাক্যিহারা হয়ে গেলাম।
মেদিনীপুর লোকাল যখন খড়্গপুর ষ্টেশনে থামলো তখন আমার রীতিমতো খিদে পেয়ে গেছে। ট্রেন থেকে নেমেই একটা দোকানে লুচি তরকারি খেয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে দেখি তার শেষপ্রান্ত দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমার হা হয়ে যাওয়া মুখ দেখে জেঠু বলে এতক্ষন যত ষ্টেশন দেখলে তার মধ্যে সব থেকে বড় প্ল্যাটফর্ম এই ষ্টেশনের।
হাওড়ার থেকেও বড়?
হাওড়ার থেকেও বড়। এখানে পরপর তিন চারটে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলেও প্ল্যাটফর্ম শেষ হবে না।
.........
টাটানগর প্যাসেঞ্জারে চেপে যখন ঘাটশিলা পৌছালাম তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ঘাটশিলার আকাশে লালচে নিভন্ত সূর্য। ছোট্ট ষ্টেশনটাকে অবহেলা করে ছুট্টে চলে গেল গোটা দুই এক্সপ্রেস আর মালগাড়ি। তারপর আমরা জীর্ন ওভারব্রিজের উপর দিয়ে ষ্টেশন পেরোতে পেরোতে দেখি ব্রিজের সিঁড়ির খাঁজে খাঁজে বেশ কিছু ঘাস গজিয়েছে। ফিকে হয়ে আসা আলোয় তাদের সবুজ রং তখনও বোঝা যায়।
ষ্টেশন পিছনে ফেলে রিকশায় যেতে যেতে মনে হলো কি বিচিত্র এই দেশ! কি বিরাট এই রেল! কত মানুষের কারিগরি! সময় মিলিয়ে ছোটার কি আপ্রাণ প্রয়াস। মানুষের এই মহাকান্ড আর শুভবুদ্ধির সামনে আমি সিঁড়ির খাঁজের ঘাসগুলোর মত নগন্য।
- তারপর?
- তারপর আবার কালকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন