ঠাকুর দেখা অথবা অন্ধকারের গল্প
: ১ :
-দুর্গাপুজো, কালীপুজো সব শেষ। ভাইফোঁটা গেলেই এবছরের মত উৎসব ঠাঠা।
-কে বলল, জগদ্ধাত্রী পুজো আছে তো।
-সে তো চন্দননগর আর কৃষ্ণনগর।
- তবু উৎসব তো।
- তা বটে। তবে সে ভূমিকম্পের আফটার শকের মত।
- তোমার তো উৎসব নিয়ে খুব একটা হেলদোল ছিলনা। আজ হঠাৎ?
- না সে আমার আজও নেই। তবু এই এত লোক আনন্দ করছে। গান শুনছে। নতুন জামা পরছে। সাজছে। বাজি ফোটাচ্ছে তারপর একদিন ধপ করে সেই যা তাই হয়ে গেল। মানুষগুলোর সেই আগের মত কোঁচকানো কপাল, বিষণ্ন মুখ। দেখে অবাক লাগে।
- আর একটু মন খারাপ খারাপ করে তাইনা?
- তা একটু করে বৈকি।
- হুমম। এর কোনো ওষুধ নেই। আমার মন খারাপের যদিও আরও একটা কারণ আছে।
- কি কারণ?
- মনে হয় সেই ছোটবেলার উন্মাদনার দিনগুলোতে আর চেষ্টা করেও ফিরতে পারব না। চেষ্টা করেও সেই আগের মত পুজো আসার আনন্দ পাবো না তাই পুজো চলে গেলে আর আগের মত দুঃখও হয়না। দুঃখটা সেখানেই।
- তোমার পুজোর আনন্দ ব্যাপারটা আমি বুঝি।
- কি, কি বোঝো শুনি?
- না তোমার পুজো মানেই তো সেই নীল পাঞ্জাবী পরা হারগিলে ছেলেটা যে হঠাৎ কাউকে দেখে পাগল হয়ে যেত। তারপর ষষ্ঠীর রাত থেকে কালীপূজা অবধি তার আরাধনা চলত। বিয়ের পরে আর সেসব হচ্ছে না। চেহারাটাও আগের মত পাতলা ছিপছিপে নেই। দুঃখ তো হবেই।
- এই যে তুমি সব কিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জায়গায় এনে ফেলে দাও। এটাই আমার বিশ্রী লাগে।
- এগুলো কি আমি ভুল বলছি? তুমি বলো।
- সেটা কথা নয়। পুজো মানে শুধু প্রেম তো নয়; অন্যভাবে বাঁচার চেষ্টা। বাঁধন ছেড়া ব্যাপার। এটা আজকাল হয় কই।আজকাল কিছুতেই যেন বিস্ময় জাগে না। সবই দেখা সবই শোনা।
- হুম। তুমি একদম বুড়ো মানুষের মত কথা বলছ।
- তাই কি? তবে শোনো। একটা ঘটনার কথা বলি। চট করে দু কাপ চা হয়ে গেলে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলা যাবে।
- ব্যাস, আবার হুকুম।
- আরে একটা জম্পেশ গল্প বলব। একটু চা না হলে হয়!
:২:
পুজোর সময় আমি সাধারণত বাড়ির বাইরে কোথাও যাইনা। সেই ছোট থেকেই পুজো মানেই বাড়িতেই। বাড়ি থেকে মণ্ডপ। সেখানে খানিক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, বাজি ফাটিয়ে বাড়ি। তারপর খেয়ে, ঘুমিয়ে বিকালে আবার। রাতে বাবার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখা। এটা প্রতিবারের রুটিন।
কিন্তু সেই বারে পুজোর সময় আমি আর মা মামারবাড়ি গেলাম। সে বড় নিরানন্দের পুজো। মামার বাড়িতে আমার বয়সি ছেলেপুলের অভাব। যারা আছে তারা আমার সাথে মেশে না। বাড়ি থেকে পুজো মণ্ডপ অনেকটা দূরে। একাএকা সেখানে যেতে দেয়না। একটা ক্যাপ বন্দুক হাতে কতক্ষন আর নিজে নিজে সময় কাটে। আমার দিনগুলো তাই বড্ড একঘেয়ে বিরক্তিকর কাটছিল। ঠাকুর দেখা নেই। লাফঝাঁপি নেই। কি যে বিরক্তি বলে বোঝানো যায়না।
এই ভাবে দিন তিনেক কেটে গেল। নবমীর দিন সকালে মেজমামা বলল আজ বিকেলে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাবে বেথুয়া। বেথুয়া তো জানোই মামারবাড়ি থেকে বেশ দূরে শহর এলাকা। অনেক ঠাকুর হয়। পুজোর ধুম খুব। আমি দুপুর থেকেই খেয়েদেয়ে নতুন জামা পরে রেডি। মামা বলল এখন নয় ঠিক পাঁচটার সময় বেরোব। আমার সময় আর কাটতে চায়না।
পাঁচটা বাজতে না বাজতেই আমার তাড়ায় মামা সাইকেল নিয়ে কেরিয়ারে একটা আসন পেতে আমাকে বসিয়ে রওনা হলো ঠাকুর দেখতে। ক্যাপ বন্দুক প্যান্টে গুঁজে, পকেটে ক্যাপ রোল নিয়ে সিটের পিছনে গোল রিং ধরে আমি গ্যাট হয়ে বসলাম। সাইকেল চলল টুকটুক করতে করতে।
বেথুয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। রাস্তায় বেশ ভিড়। লাইটিংগুলো জ্বলবে জ্বলবে করছে। গান চলছে। সঙ্গে জেনারেটর। রাস্তার ধারে ধরে মেলার মত ফেরিওয়ালা বসেছে। বাঁশি, পুতুল, বাজি, টুপি মায় পাঁপড় রোলের দোকান। দূরের দূরের গ্রাম থেকে হেঁটে হেঁটে, ভ্যানে চেপে ঠাকুর দেখতে এসেছে কত্ত মানুষ। আজ শেষ দিন। রাত পোহালে কাল দশমী। আমিও দেখলাম অনেক ঠাকুর। কতরকম তার আদল। অসুরের গায়ের নানান রং। বিচিত্র মুখভঙ্গি। সিংহের বিভিন্ন গড়ন। দেখে আমার শেষ হয়না।
ওদিকে দু একপা যেতে যেতেই মামার চেনা কেউ না কেউ এসে যায়। দু পাঁচ মিনিট কথা না বলে যাওয়াও যায়না। এই করতে করতে রাত হয়ে এলো। প্রায় সাড়ে নটাই হবে হয়ত; মামা বলল আর নয়। এবার বাড়ি। আমি সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরলাম। শেষে বাটি আইসক্রিম খেয়ে আমি আবার কেরিয়ারে গ্যাট হয়ে বসলাম। আমাদের সাইকেল বাড়িমুখো চলতে শুরু করল।
:৩:
রাস্তার ভিড় কাটিয়ে, ধীরে ধীরে মামার সাইকেল এগোতে লাগল। শহরের আলো আবছা হয়ে এলো। শেষ লাইটিং মিলিয়ে গেল। মাইকের গান আস্তে আস্তে একসময় আর শোনা গেল না। জনবসতি পাতলা হয়ে এলে নামলো নিরেট অন্ধকার। দুপাশে কিছু গাছ আর চাষের জমির মধ্যেখান দিয়ে রাস্তায় বোধয় আমরা তিনটি প্রাণী। আমি, মেজমামা আর সাইকেল। তার প্যাডেল আর চেনের একঘেয়ে ক্যাচ কুচ শব্দে মাথা যেন ঝিম ধরে যায়। সামনে এখনো অনেকটা রাস্তা। ভয়ে আমার গলা কাঠ হয়ে এলো।
সিটের রিং ধরার বদলে খামচে ধরলাম মামার জামাখানা। মামা বুঝতে পেরে হেসে বলল।
-কি, ভয় করছে?
-হুঁ।
-ভয় কিসের?
-ভূত
-ধুর। ওসব এখানে নেই।
অথচ আমি জানি সামনে রাজাপুর ডাকাত কালীতলা, তারপর ডানদিকে কবরস্থান। ভুত ওখানে না থাকলে থাকবে কোথায়!
মামা তখন আমাকে ব্যস্ত রাখতে বলল - এই একহাতে টর্চ আর সাইকেল নিয়ে আমার বড্ড অসুবিধা হচ্ছে। তুই টর্চটা ধরতে পারবি?
আমি টর্চটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে আলো ফেললাম। ভয়ে আমার চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছা হলো তবু কিসের যেন আকর্ষণে টর্চ ফেলে সামনে রাস্তার দিকে চেয়ে রইলাম। দু তিনটে শেয়াল সুরসুর করে শব্দে আর আলো দেখে নীচে ক্ষেতের দিকে নেমে গেল। আর টর্চের আলোও তেমন! মিটমিটে, ঘোলাটে আলোয় বারবার মনে হলো এবার কেউ হটাৎ আমাদের সাইকেলের সামনে এসে পড়বে। আমার চোখ বুঁজে ফেলতে ইচ্ছা হল কিন্তু তবু পারলাম না।
সেই ভয়, নবমীর আধভাঙ্গা চাঁদ, সাইকেলের চেনের একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ আর চরাচর জুড়ে নিঝুম অন্ধকার পার করে যখন বাড়ি এলাম রাত তখন প্রায় এগারোটা।
মামারবাড়ির গোটা পাড়া তখন নিস্তব্ধ। দূরে কয়েকটা কুকর ডাকছে সমানে।
রাতে দুধভাত খেয়ে মায়ের কোলটি ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম।
আজও। আজও জানো, মাঝেমাঝে আমি সেই অন্ধকার খুঁজি। সেই ঘোলাটে হলদে টর্চের আলো খুঁজি। সেই শেয়ালের জ্বলজ্বলে চোখ আর অদৃশ্য ভুতটাকে খুঁজি। আর খুঁজি মেজমামা কে।
পুজো আসবে। কিন্তু এরা আর ফিরবে না।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন