একটি অন্তর্ঘাতের গল্প

পৃথিবীতে এর আগে যত আন্দোলন হয়েছে তার একটা কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেই বিন্দু থেকে একটা ঢেউ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কিন্তু এক জায়গায় যখন সে ঢেউ পৌঁছায় অন্য জায়গায় তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। একসাথে তামাম দুনিয়া জুড়ে এমন আন্দোলন আগে কোনোদিন হয়নি। রাষ্ট্রনেতারা প্রমাদ গুনলেন। এদের দাবী যদিও আশু রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটাচ্ছে না; কিন্তু চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে আর এমন কোনো সম্ভবনা থাকলে তা অঙ্কুরেই বিনাশ করা উচিত।

আন্দোলনকারীদের দাবী যদিও আপাত নিরীহ। তাঁরা বলছেন সুন্দর ও কুৎসিত এই দুটি শব্দ অভিধান থেকে বাদ দিতে হবে। গোটা বিশ্ব জুড়ে শুধু এই নিয়েই মিটিং মিছিল। প্ল্যাকার্ড হাতে হাজার হাজার মানব মানবী। তাদের নানা ভাষা, নানা আকার, নানা বয়স। 

আপাতত তাদের প্রস্তাব অন্তত দৈহিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতিতে যে বাঁধাধরা মানদণ্ড, যে অলিখিত নিয়ম আছে তা ছুঁড়ে ফেলতে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ এই অভিধান থেকে শব্দদ্বয় বাদ দেওয়ার কর্মসূচি। 

এমনিতে জনগণের স্মৃতিশক্তি খুব একটা প্রবল নয়। মানুষ ভুলে যায়। কেউ কেউ যদিও মনে রাখে। খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করতেই থাকে তারা। কিন্তু জনগণের নতুন হুজুকের প্রতি মোহ দেখে তারা অচিরেই আশাহত হয় নাহলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। চিরকাল এভাবেই হয়ে এসেছে। কিন্তু এবারে সেটা হচ্ছে না। সাধারণ যেন আদা জল খেয়ে এই অসাধারণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেই পণ করেছে। দেশে দেশে রাষ্ট্রপ্রধানেরা এখানেই একটা অনাগত ঝড়ের পূর্বাভাস দেখছেন। দুটিমাত্র শব্দ, তা বাদ দিলে পৃথিবীর কোনো ভাষার বা সংস্কৃতির বা অভিধানের কোনো যায় আসে না। কিন্তু! একটা বড় প্রশ্ন যা তাঁদের ভাবাচ্ছে তা হলো এর পর কি দাবি করে বসবে এই খেয়ালি জনসাধারণ? হয়ত এরপর বলবে জাতপাত তুলে দাও। বলবে ধর্ম ব্যাপারটাই মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে, অতএব তুলে দাও। তারপর বলবে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু ব্যাপারটা আসলে একটা ফালতু জিনিস। তারপর তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ  ভোটে জেতা রাষ্ট্র নেতার অবাধ্য হবে। রাজাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে পথে টেনে আনবে। ধনী ও নির্ধনের পার্থক্য মানবে না। শেষে বলবে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে ভালো মন্দ বলেও কিছু হয়না। অতএব এটা ভালো ওটা মন্দ এমন দাগিয়ে দিও না।

আজ যদি একটা ছোট দবীও মেনে নেওয়া হয় তবে তারা সাহস পেয়ে যাবে। আর জনতার উৎসাহ ব্যাপারটা নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার না করতে পারলে সে বড় ভয়ঙ্কর অস্ত্র। দমন করতে হবে। 

সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দেওয়া হলো। কিন্তু সাধারণ অস্ত্রধারীরা অনেকে বেঁকে বসলেন। তাঁদের অনেকেই জনগণের দাবীর সমর্থক।  হাই কম্যান্ডের নির্দেশ অমান্য করা! এতো ভীষণ ভয়ঙ্কর প্রবণতা! রাষ্ট্রনেতারা এবারে দারুন ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমেই বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করে আলাদা করা হলো। তারপর গোপনে তাদের মেরে ফেলা হলো। গোটা পৃথিবী জুড়ে এত বিরাট হত্যাযজ্ঞ আগে হয়নি। 

সরকারপক্ষীয় বাহিনী দিয়ে আন্দোলন রোধ করার চেষ্টা করে দেখা গেল জনগণের অনড়। তাদের জেদ বেড়ে যাচ্ছে। এখন উপায়?

এক দেশে এক আমলা বললেন উপায় আছে। সে দেশের আন্দোলনকারীদের নেতাদের মধ্যে থেকে বেছে নিতে হবে দুই নারী, দুই পুরুষকে। তারপর আলোচনা করে পথ বেরোবে। সে দেশের সে সময়ের নীতি ও মানদন্ড অনুযায়ী এক সুঠাম আকর্ষণীয় যুবা পুরুষ এক অসাধারণ লাস্যময়ী নারীকে বেছে নেওয়া হলো। এদের বাংলায় বলা যায় "সুন্দর"। বেছে নেওয়া হলো ভুঁড়িওলা মেদবহুল বিরলকেশ আরেক পুরুষ ও ক্ষীণতনু রুক্ষকেশ অবনত বক্ষ আরেক নারীকে। বাংলায় যাদের বলে যায় "কুৎসিত"। এরা সবাই এসেছেন আলাদা আলাদা প্রদেশ থেকে ও কেউ কাউকে চেনেন না। 

আলোচনা কক্ষে দেখা গেল "সুন্দরের" পাশে "সুন্দরী" এবং কিছুটা দূরত্ব রেখে একটু পরপর বসেছেন দুই তথাকথিত "অসুন্দর"। আমলা ব্যাপারটা লক্ষ করে মুচকি হাসলেন অলক্ষ্যে। তাদের প্রস্তাব দেওয়া হলো সরকারি ভবন ও মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে ও সরকারি আতিথিয়তা গ্রহণ করতে কারণ কিছু বিশেষ কাজে সরকার একদিনের জন্য আলোচনা পিছিয়ে দিয়েছেন।

মিউজিয়াম ও ভবন পরিদর্শনকালে দেখাগেল দুই "সুন্দর" যুগল খুব উৎসাহের সাথে হাত ধরাধরি করে সব ব্যবস্থা দেখছেন। বাকি দুজন যেন কিছুটা উদাস ও একা।অতিথিশালায় দুই "সুন্দর" যুগল একই ঘরে থাকতে সানন্দে রাজি হলেন। কিন্তু দুই তথাকথিত "কুৎসিত" যুগল নিজেদের জন্য আলাদা ঘর চাইলেন। দুই দলেরই একজন করে দুজন পুরুষ ও দুই নারীকে এক ঘরে শুতে যেই বলা হলো, দেখাগেল তাতে চারজনই বেশ অসন্তুষ্ট।

পরেরদিন সরকারপক্ষ থেকে বারবার চারজনকে অনুরোধ করা হলো আন্দোলন তুলে নিতে। তারা রাজি হলেন না। আবার তাদের বোঝানো হলো এই নীতি আসলে দেশের অরাজকতা ডেকে আনবে। অতএব দেশের স্বার্থে তাদের থেমে যাওয়া উচিত। তারা মানলেন না।

আমলা দমলেননা। বল প্রয়োগ করতে হবে। 

সরকার থেকে বলা হলো এবারেও যদি তারা রাজি না হন তবে "সুন্দরী" মেয়েটির সাথে বিরলকেশ ভদ্রলোকের ও ক্ষীণতনু ভদ্রমহিলার সাথে জোড় করে সুঠাম যুবকের বিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দুটি নির্জন দ্বীপে চালান করে দেওয়া হবে। 

এই প্রথম দুই আন্দোলনকারীরা ভয় পেয়ে গেলেন। দুই "সুন্দর" যুগল পরস্পরের হাত চেপে ধরলেন। দুই "কুৎসিৎ" মানব মানবী যেন একটু উৎফুল্লই। 

অতঃপর "সুন্দর" যুগল আত্মসমর্পণ করলেন। তাঁরা আর আন্দোলন করতে চান না। অন্য দুজন এখনও লড়ে যেতে চান।সরকার তরফের আমলা আবার একটু হাসলেন। তারপর বললেন না হে তোমরা ফিরে যাও। আন্দোলন চলুক।

সরকার তারপর ধীরেচলো নীতি নিয়েছিল। 

আশার কথা এরপর দেশে দেশে শান্তি এসেছে। অভিধান থেকে বাদ গেছে একটি শব্দ - সাম্য।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা