বাংলার স্থাননামে বীরত্বের প্রভাব (তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা)

বৈচিত্র্যময় বাংলার স্থাননাম। স্থান নামের উৎপত্তি ও তার কারণগুলোও বিচিত্র। কোনো এলাকার বিখ্যাত ব্যক্তির নামে বা কোনো বিশেষ জিনিসের আধিক্যের জন্য সেই এলাকার নামকরণ হওয়া এর মধ্যে খুব সাধারণ দুই কারণ। যেমন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামে কৃষ্ণচন্দ্রপুর বা মুর্শিদকুলী খাঁয়ের নামে গোটা মুর্শিদাবাদ। শাল গাছের আধিক্য বা শালের বন থাকার জন্য শালবনী। পলাশ গাছ ও ফুল থেকে পলাশী, ইত্যাদি। কিন্তু কোনো স্থানের নামকরণের পিছনে সাহসিকতা, বীরত্ব ও দৃঢ়তাকে কারণ হিসেবে বড় একটা মেলেনা। তবে আমাদের বাঙলাতেই বা বলা ভালো পশ্চিমবাংলাতেই তেমন উদাহরণ খুঁজলে বেশ কয়েকটা পাওয়া যাবে। শুরু করা যাক পূর্ব মেদিনীপুরের একটা গ্রামের নাম থেকে। এই গ্রামের নামের সাথে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা আন্দোলন আর একদল সত্যগ্রহীর সমষ্টিগত সাহসিকতা, বীরত্বের কাহিনী।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু হিসাবে ধরা হলেও ব্রিটিশদের গোটা ভারত দখল করতে আরও বেশ কিছু বছর সময় লেগেছিল। ১৮৩৫ সাল নাগাদ ছলে বলে কৌশলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিরাট অখন্ড ভারতবর্ষের প্রায় সবটাই নিজেদের আয়ত্তে এনে ফেলে। এবার লাভের গুড় ঘরে তোলার পালা। তৈরি হয় নানা আইন। বিভিন্ন খাতে হরেক রকম শুল্ক চাপিয়ে ভারতবাসীকে শোষণের কাজ পুরোদমে চালু করে ইংরেজরা। তাদের এই শোষণমূলক আইনগুলোর একটা হলো লবন আইন। এই আইন অনুসারে ভারতীয়দের লবন তৈরি, মজুত ও বিক্রির উপর ট্যাক্স বসানো হয়। সামান্য নুন হয়ে ওঠে দুর্মূল্য। আর তার ফলে দেশের বৃহত্তর গরীব জনগণের কাছে নুনভাত জোটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
১৯৩০ সালের মার্চ মাসের কথা। গান্ধীজি তাঁর সবরমতী আশ্রম থেকে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন ৩৯০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের ধরে ডান্ডি গ্রামের দিকে। এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ ডান্ডি পৌঁছে প্রথমে সমুদ্রের জলে অবগাহন করে গান্ধীজি সমুদ্রের জল নিয়ে অনুমতি ছাড়াই লবন তৈরি করে লবন আইন ভেঙে দেন ও গ্রেপ্তার হন। এরপর সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। বাংলার মানুষও এই আন্দোলনের পা বাড়ায় অচিরেই।
মেদিনীপুরের বহু সংগ্রামী মানুষ আগেও সত্যাগ্রহ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবারেও তার অন্যথা হলো না। ডক্টর সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কাঁথি - রামনগরের সীমানা দিয়ে বয়ে চলা খালের কাছে জমা হন এক দল লবন সত্যগ্রহী। তাঁরা লবন আইন ভঙ্গ করতে উদ্যত হতেই ততকালীন ইংরেজ প্রশাসনের আধিকারিকরা তাঁদের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে ও পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। সমবেত দৃঢ় কণ্ঠে স্থানীয় ভাষায় সত্যগ্রহীরা বলে - "আমরা পিছাবনী"
অর্থাৎ আমরা পিছিয়ে যাব না। সেই থেকে ওই এলাকার নাম পিছাবনী। পিছাবনীতে গড়ে উঠেছিল লবন সত্যাগ্রহ কেন্দ্র। আন্দোলন সেখানে দমন করা যায়নি তবে ইংরেজদের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। শুধু অত্যাচারে কাজ না হওয়ায় গুলিও চলেছিল। তাতে শহীদ হন দুজন এলাকাবাসী। জেলা ভাগের পর পিছাবনী বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরে। পরবর্তী কালে পিছাবনীতে স্থানীয়দের উদ্যোগে তৈরি হয় লবন সত্যাগ্রহ স্মারক স্তম্ভ। ২০০৫ সালে পিছাবনী খালের উপর তৈরি নতুন ব্রিজের উদ্বোধন করা হয়। নাম দেওয়া হয় লবন সত্যাগ্রহ স্মারক সেতু।

মেদিনীপুর থেকে এবার ঘুরে আসা যাক নদীয়ার এক গ্রামে। এই গ্রামটির নামকরণের পিছনে যদিও কোনো আন্দোলনের কাহিনী নেই। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা যা জানতে পারি তাতে এখনও এলাকার মানুষেরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের সাহস আর বীরত্ব নিয়ে গর্ব করতে পারেন।
রানাঘাট আর কৃষ্ণনগরের মাঝে নদীয়া জেলার এক প্রাচীন জনপদ উলা। কেউ বলে উলুবন থেকে জায়গার নাম হয় উলা আবার কেউ বলে পার্সি শব্দ আউল থেকে উলার নামকরণ যার অর্থ হলো জ্ঞানী। প্রায় দুইশতাধিক বছর আগে এই উলা গ্রামে ডাকাতের বড় দৌরাত্ব ছিল।
সেবার স্থানীয় জমিদার মহাদেব মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। অত্যাচারে জর্জরিত, ক্রুদ্ধ জনতা গেল ক্ষেপে। শেষে তাদের তৎপরতায় সেদিনই ডাকাতদল ধরা পরে। বেশ কয়েকজন আহত হয়। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ডাকাত জখম হয়। শেষ অবধি ধরা পরে দলের ১৮ জন যাদের মধ্যে সেকালের বেশ কয়েকজন দাগী দুষ্কৃতীও ছিল। বিচারে তাদের সাজা হয়।
উৎসাহী জনগণ তখন এলাকার নাম পরিবর্তনের দাবি করেন। তা মঞ্জুরও হয়। সেই থেকে সরকারী ভাবে গ্রামবাসীর বীরত্বের চিন্হ হিসাবে উলার নামকরণ হয় বীরনগর।

বীরত্ব, ভীরুতা দুই'ই বড্ড ছোঁয়াচে। একদল মানুষের মধ্যে একজন বা দুজন মানুষ সাহসী হলে সেই সাহস বাকি সবার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আবার মাত্র দু একজন নেতিবাচক মানুষের পাল্লায় পড়ে একসাথে অনেকেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা স্থিরমতি, অন্যের দ্বারা যারা সহজে চালিত হয়না, কঠোরতা , কোমলতা মিশিয়ে তাদের মানবিক গুণাবলী ইতিহাস তৈরী করে অনেক সময়। এবার তেমনই একটা ইতিহাস শোনা যাক। এই ইতিহাস একটা রাস্তার। কলকাতার বুকে কালীঘাট, ভবানীপুর এলাকার একটা ছোট্ট অকিঞ্চিতকর রাস্তা। প্রিয়নাথ মল্লিক রোড থেকে শুরু হওয়া রাস্তাটা ইংরেজি ওল্টানো L অক্ষরের আকারে মিশেছে হাজরা রোডে। নাম নফর কুন্ডু রোড।
যাঁর নামে একটা গোটা রাস্তা তা সে যত ছোটই হোক তিনি একজন কেউকেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু নফর চন্দ্র কুন্ডু ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। তিনি রাজনীতি করেননি, অভিনয় করেননি, স্বাধীনতা সংগ্রামে তার নাম পাওয়া যায়না, এমনকি খেলোয়াড় হিসাবেও নাম করেননি। তবু একটা গোটা রাস্তা মায় একটা মেমোরিয়াল মনুমেন্ট রয়েছে তাঁর স্মৃতিতে।
১৯০৭ সালের ঘটনা। দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়িয়া দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নফর বাবু হঠাৎ শুনতে পেলেন কেউ চিৎকার করে সাহায্য চাইছে। কাছেই একটা জটলা। এগিয়ে গিয়ে শুনলেন ম্যানহোলের নোংরা সাফ করতে গিয়ে দুই সাফাই কর্মী বিপদে পড়েছে। বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে তারা কিছুতেই উপরে আসতে পারছেনা। নিচ থেকেই সাহায্য চাইছে। লোক জমেছে বিস্তর কিন্তু কেউই সাহস করে তাদের ঠিকমত সাহায্য করতে পারছে না। নফর বাবু আর দ্বিতীয় বার ভাবেননি। অনেকের নিষেধ সত্ত্বেও খোলা ম্যানহোলে নেমে দুই কর্মীকে উদ্ধার করেন তিনি। তারা প্রাণে বেঁচেও যায়। কিন্তু অতিসাধারণ আমজনতার একজন নফর চন্দ্র কুন্ডু, সেদিন দুজন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নোংরা ম্যানহোলের বিষাক্ত গ্যাসে প্রাণ হারান মাত্র ২৭ বছর বয়সে।
অনেক সময় বীরত্বর নেশা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির ফলে মানুষের মনে ক্ষনিকের সাহস ভর করে। বীরেরা বন্দিতও হন। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর গুলিতে যে সৈনিক শহীদ হন দেশ তাকে ভোলেনা। কিন্তু যে কৃষক দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে ফসল ফলিয়ে আমাদের অন্ন সংস্থান করে শেষে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেন তার কথা আমরা মনে রাখিনা।
নফর কুন্ডু সাহসী মানুষ ছিলেন একথা বলাই বাহুল্য।সেদিন বাকি সবার মতো তিনিও নোংরা ম্যানহোলে না নেমে উপর থেকে হা হুতাশ করে বাকি জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দিয়ে নাম করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি দুজন সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের প্রাণ বাঁচান নিজের বিনিময়ে।
তবে তাঁর আত্মত্যাগ সেদিনের কলকাতা ভোলেনি। সেই এলাকায় রাস্তার নামকরণ হয় তার নামে। সেই ম্যানহোলের কাছেই তৈরি হয় স্মৃতিস্তম্ভ যা আজও এক অতিসাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প বলে।

দিব্যেন্দু সিংহ রায় (১৪ এপ্রিল ২০২৩)

****
২০২৪ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত "গল্প কথায় বাংলার স্থাননাম" (সম্পাদনা অতনু টিকাই টিকাইৎ ও চৈতালি মাহাত) বইতে এই লেখাটা স্থান পেয়েছিল। তথ্যগুলো মোহিত রায়ের লেখা নদীয়ার স্থাননাম, সমরেন্দ্রনাথ চন্দ সংকলিত গল্পে গাথায় ছন্দে বাংলা স্থাননাম থেকে এবং এই সময় পত্রিকা ও কিছু অন্যান্য ওয়েব পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে নেওয়া ও যাচায় করা। (পিছাবনী গ্রামের গল্প প্রথম শুনেছিলাম নন্দকুমারবাসী বান্ধবীর থেকে)
একটি তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখতে অনেক পড়াশুনো ও প্রয়োজনে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে হয়। দরকার হয় নিষ্ঠার। সেসব ব্যাপারে আমি অনেকটাই পিছিয়ে। তাই তথ্যগত কোনো বিচ্যুতি থাকলে তার দায় নিতে ও সংশোধন করতে প্রস্তুত রয়েছি।
চিত্র সৌজন্য: উইকিমিডিয়া

(DSR - 15/05/2023) 




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা