লোডশেডিংয়ের গল্প

সেবার যখন হঠাৎ বুনো শুয়োরের মত গোওওওঙ-গোঙ শব্দ করে আমাদের পাড়ার মোড়ের ট্রান্সফর্মারটা খারাপ হয়ে গেল, এলাকাবাসী হকচকিয়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনা আগে ঘটেনি, এমন শব্দও আগে শোনা যায়নি। আসে পাশের অনেকটা এলাকা জুড়ে একটাই ট্রান্সফর্মার। কারেন্ট কবে আসবে কে জানে। কেউ বলেছিল সাত দিন। কেউ বলেছিল মাস খানেকের আগে হতেই পারেনা। শুধু দেব দ্বিজে ও সিপিএমে যাদের অপার ভক্তি তারা বলেছিল দিন দুয়েকের মধ্যে এসে যাবে। ঠিক সাড়ে চার দিনের মাথায় একটা ৪০৭ গাড়ির পিঠে চাপিয়ে নতুন ট্রান্সফর্মার এনে লাগানোর কাজ যখন শুরু হলো পাড়ার মোড় তখন জনারণ্য। ইলেকট্রিক অফিসের লোকেরা দড়ি বেঁধে পুরোনো অক্ষম যন্ত্রটা নামাচ্ছিল। স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে এলাকার একচেটে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি গণেশ কাকু প্যান্টটা গোঁড়ালি উপর গুটিয়ে তাতে হাত লাগায়। ঘন্টা চারেকের পরিশ্রমের পরে যখন প্রতিস্থাপন শেষ হয়ে মেন সুইচ অন করার পালা তখন জনগণকে তফাৎ যেতে অনুরোধ করা হয়। কারেন্ট আসতেই সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে আর উদ্দীপনার ঢেউ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আবার ঘোওওওঙ নাদে নতুন যন্ত্রটিও দেহ রাখে।  প্রাচীনপন্থী অনেকের মতে ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রের সঙ্গে একালের পাল্লা দিতে পারার কথা নয়। আগেরটাই অরিজিনাল তমা আর রুপোর পাত ছিল। নতুনটা দেখেই বোঝা যায় পুটপুটে। অদৃষ্টবাদী কেউ কেউ বলেছিল - সবই কপাল।

ইংরেজিতে ভীষণ বেঁড়েপাকা আমি ছিলাম এলাকার একমাত্র বাঙরেজি মিডিয়ামের নামি ছাত্র। "লোডশেডিং" শব্দের লোডের অর্থ আমি জানতাম। শেডিং ব্যাপারটা কি আন্দাজ করে নিতে হয়েছিল। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুতের যোগান অপ্রতুল। ধান চাষের সময় প্রচুর জল লাগে। তাই রাত সাতটার পরেই কারেন্ট সেদিকে সাপলাই হতো। আমাদের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত হ্যারিকেন, কাঁচের চিমনি দেওয়া কেরোসিন টেবিল ল্যাম্প, মোমবাতি, লম্ফ বা কুপি। মশা তাড়াতে হ্যারিকেনের মাথায় দেওয়া হতো গুডনাইটের চ্যাপ্টা, চৌকো ট্যাবলেট। ছেলেপুলে সেই আলোয় দুলে দুলে পড়ত। এই দুলতে দুলতেই একদিন একগোছা চুল চিমনির মাথায় পড়তেই উৎকট পোড়া গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখা গেল চুল পুড়ে খড়খরে হয়ে গেছে। তারপর থেকে একটা নতুন খেলার সন্ধান পাওয়া গেল।

লোডশেডিং আমাদের হতাশ করেনি। চার পাঁচ ঘণ্টা পরে কারেন্ট ঠিকই ফিরত। বিরক্ত করত শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে যখন সিন্দাবাদের তিলেসমি তরোয়াল থেকে আগুন ছুটছে তখন সেই পুন্যাগ্নি শয়তানের গায়ে লাগার আগের মুহূর্তে কারেন্ট চলে গিয়ে। আমরা গুম মেরে বসে থাকতাম। এভাবে কত শনি রবিবার আমাদের বেকার হয়ে গিয়েছিল তার হিসেব কোথাও লেখা নেই।

রাতের দিকে পড়া শেষ করে ছাদে যাওয়া হত। ন্যাড়া ছাদ তাই একা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। একসাথে দল বেঁধে অথবা বাড়ির কোনো বড় মানুষের সঙ্গে কাঁধে মাদুর নিয়ে ছাদে ওঠা তখন যেন একটা বিস্ময়পুরীতে ভ্রমণ, কারণ কদিন আগেও ছাদে উঠত কেবল বাড়ির পুরুষেরা, অতি প্রয়োজনে মই বেয়ে। সিঁড়িটা তখনও হয়নি। 

ছাদে উঠলে দৃশ্যপট বদলে যেত। অন্যান্য বাড়ির ছাদ থেকে খোশগল্পের আওয়াজ ভেসে আসত। একটু দূরে আমবাগানের মাথার ঘুপচি অন্ধকার থেকে পেঁচো ভুতেদের চোখ নজর রাখত সবই। আকাশ ভরা চন্দ্র তারার দিকে তাকিয়ে রেখায় রেখায় মিলিয়ে নেওয়া হত সপ্তর্ষি মন্ডল, কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া।

পাড়ার মোড়ের ট্রান্সফর্মার অনেকদিন তার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে আরো অনেকের কাঁধে। বাড়িতে বাড়িতে বসেছে ইনভার্টার। দেওয়ালে দেওয়ালে স্প্লিট এ.সি। শ্বেতপাথর মোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় আকাশ এখন উদ্ভাসিত। কালপুরুষ তার কুকুর নিয়ে ছুটিতে গেছে।

 একশো ওয়াটের বাল্ব, দপদপ করা রড লাইট, সি এফ এল  বাতির হাত ধরে আমরা এল ইডির যুগে। রাত আসে কিন্তু অন্ধকার আসেনা। বিলুপ্ত হওয়ার আগে লোডশেডিং যাকে তার ব্যাটন দিয়ে গেল তাকে আজকাল আমরা "পাওয়ার কাট" বলি।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা