কালকা - সিমলার মাঝপথে
১৯ শতকের শেষ দিকের কথা। সিপাহী বিদ্রোহ দমন করে কোম্পানি শাসন উঠে গিয়ে ভারতবর্ষে রানীর রাজত্ব। ইংরেজরা ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে। ভারতবর্ষ গরমের দেশ। এই গরমে শাসন চালিয়ে যেতে মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ অবসরও প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘরোয়া আবহাওয়ায় ছুটি কাটানোর মত কিছু জায়গা যেখানে পরিপাটি করে সাজানো থাকবে শখের বাংলো। গরমে, কাজের চাপে হাপসে যাওয়া সাহেবরা বাংলোর বারান্দায় চা সহযোগে ধূমপান করতে করতে স্মৃতিতে খুঁজে পাবে তাদের ফেলে আসা দেশকে। খোঁজ শুরু হয় "হোম ওয়েদারের"। এভাবেই বিরাট ভারতবর্ষের নানা পাহাড়ি অঞ্চলে গড়ে ওঠে শৈলবাস। বাংলার দার্জিলিং, হিমাচলের সিমলা, ঝাড়খণ্ডের ম্যাকলস্কিগঞ্জ এমনই অবসরের শহর।
এসব ছোট শহরের পৌঁছতে হয় পাহাড়ের গা বেয়ে। কিন্তু মানুষ তো তা পারে না, দরকার যানবাহন। পাহাড়ি এলাকা, সংকীর্ণ ধ্বসপ্রবন উপত্যকা। বড় আর ভারী রেলগাড়ি এখানে চলবে না। দরকার হালকা পোক্ত কিছু। একটু ধীর লয়ের হলেও ক্ষতি নেই। চলতে চলতে উপভোগ করে নেওয়া যাবে দৃশ্যপট। গড়ে ওঠে রেলপথই, তবে বড় গাড়ির নয় ছোট্ট খেলনার মত রেলগাড়ির দুফুট আড়াই ফুট চওড়া ন্যারো গেজ রেলপথ।
এই ছোট রেলপথ ভারতের বহু জায়গায় তৈরি হয়েছিল। ইংরেজ ছাড়াও তৈরি করেছিলেন অনেক দেশীয় রাজারা। এই শতাব্দীর শুরুর দশক অবধি টিকেও ছিল অনেক জায়গায় কিন্তু বড় রেলের গতি আর মানুষের প্রয়োজনীয়তার কাছে হার মেনে দেশের বেশিরভাব ছোট রেলপথ এখন অবলুপ্ত। কিন্তু যারা টিকে আছে তারা থেকে যাবে। থাকবে পর্যটনের স্বার্থে।
এমনই এক রেলপথ হলো কালকা- সিমলা ছোট রেলপথ। শিবালিক পর্বতমালার গা বেয়ে, নয়নাভিরাম পাহাড়, জঙ্গল,সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ভারতের সব থেকে লাভজনক ছোটরেলগুলো চলে এই লাইনে। প্রায় ৯৬ কিমি লম্বা এই রেলপথের ঠিক মাঝামাঝি একটা ষ্টেশনের নাম "বারোগ" বা বড়োগ। কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার পথে অসংখ্য সুড়ঙ্গ পার হতে হয়, তারমধ্যে সব থেকে বড় সুড়ঙ্গ, টানেল নাম্বার ৩৩ পার করেই বারোগ ষ্টেশন। রেলের অন্যতম দর্শনীয় এই ষ্টেশনে নামলে মনেহয় রেল যাত্রীদের মত সময়ও এখানে থমকে দাঁড়িয়েছে, তারপর অপূর্ব পরিবেশ পেরিয়ে এগোতে পারেনি আর।
আমাদের গল্পের শুরু এই বারোগ ষ্টেশনের একটু আগের সেই টানেল নাম্বার ৩৩ থেকে। ১৯০৩ সালের ৯ নভেম্বর এই পথে রেলের ট্রায়াল রান হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে জমি জরিপ ও মাপ জোকের কাজ শুরু করেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার হেরিংটন সাহেব বুঝেছিলেন রেল চালাতে গেলে পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ তৈরি করতে হবে। সেইমত এই টানেল নম্বর ৩৩ এর কাজ শুরু করেন কর্নেল বারোগ সাহেব।
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা করতে এক ছবি ব্যবহার করা হয়। দুই পক্ষ দুদিক থেকে একটা রেলপথ পাততে পাততে একদল এগিয়ে গিয়ে ও আরেক দল পিছিয়ে এসে যেখানে মিলিত হচ্ছে রেলপথ সেখানে হিসেবের ভুলে আর মিলছে না। পন্ডশ্রম, ভুল পরিকল্পনা আর সময়ের অপব্যবহার বোঝাতেই এই রসিকতা। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে এই টানেল নম্বর ৩৩ তৈরি করতে যে দুই দল পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছিল ও পিছিয়ে আসছিল তারা যখন মিলিত হয় তখন বোঝাযায় হিসেবের সূক্ষ্ণ গরমিলে এই সুড়ঙ্গ দুটোর মুখ মিলে যায়নি বরং দুটো আলাদা সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে গেছে। এই বিপুল সময় আর শ্রমের অপচয়ের জন্য কর্নেল বারোগকে ধিক্কৃত হতে হয় বিস্তর। প্রতীকী জরিমানা হিসাবে একটাকা দিতে হয় সাহেবকে।
হতাশ, অপমানিত বারোগ সাহেব এরপর একদিন পোষ্য কুকুরটি সঙ্গে নিয়ে টানেলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হন তারপর নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। মালিকের কাণ্ডে হতভম্ভ কুকুরটি শেষে লোক জড়ো করে আনে নিচ থেকে। সাহেবকে কবর দেওয়া হয় স্টেশনের কাছেই। তাঁর স্মৃতিতে ষ্টেশন ও শহরের নাম হয় বারোগ।
তারপর বহু বছর কেটে গেছে। বারোগ এখন নিসর্গ ও নির্জনতার নামান্তর। কেউ কেউ বারোগ ষ্টেশন ও এই সুড়ঙ্গে ভৌতিক অনুভূতি হওয়ার দাবি করেছেন।
২০২১ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় ২০০৭ সালে ইউনেস্কোর একটি দল এই পথে বারোগের ইতিহাসের সন্ধান করতে এসে কর্নেল বারোগের কবরটি খুঁজতে গিয়ে বিফল হয়। বেশ কিছু বছর ধরে বারোগ সাহেবের এই কবরখানা শুধু অদৃশ্য তাই নয় সে সময় রেলপথের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকাশিত জার্নাল ও রিপোর্টে কর্নেল বারোগ ও এই সুড়ঙ্গ তৈরি নিয়ে তাঁর বিফলতা ও সময় অপচয়েরও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং মুখে মুখে পল্লবিত হয় আরও একটা গল্প। ভালকু বাবা নামের এক ভারতীয় সাধু নাকি এই পথে রেল স্থাপন করতে ইংরেজদের অনেক সাহায্য করেন। ভাইসরয় তাঁকে সম্মানিত করলেও গেজেটিয়ার ও রিপোর্টে চেপে যাওয়া হয় তাঁর প্রসঙ্গও; বলা হয় উন্নততর প্রযুক্তির কথা যাতে রেলপথের কাজ ঠিক সময়ে শেষ করা গিয়েছে। নিজেদের ব্যর্থতা বা একজন বিজাতীয়র সাহায্যের কথা অস্বীকার করা সেকেলে বর্নবিদ্বেষী ইংরেজদের কাছে অসম্ভব কিছু নয় তবে শিমলায় বাবা ভালকুর নামে তৈরি হয় রেল মিউজিয়াম।
কর্নেল বারোগ বা ভালকু বাবার কান্ডগুলো সত্যি না সবই জনশ্রুতি তা হয়ত আজ আর জানা সম্ভব নয় কিন্তু আজও এই পথে খেলনা ট্রেনে দুলকি চালে চলতে চলতে পর্বত ও অরণ্যের নিসর্গের মাঝে কোনো সুড়ঙ্গের গভীর অন্ধকারে অনুভূত হয় এক হতভাগ্য সাহেবের দীর্ঘশ্বাস। সুড়ঙ্গের শেষে ফুটে ওঠে এক উদ্যমী ভারতীয়র চোখের আলো।
তথ্যসূত্র:
বই: আমাদের ছোট রেল (লেখক: রমেশ দাস - পারুল প্রকাশনী)
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।

.jpeg)


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন