অর্জুন খেপার মিলন মেলা
নদীয়ার প্রান্তিক গ্রাম গোয়াস। কাছেই সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া জেলা। শীত শেষের পড়ন্ত বিকেল। রাস্তার দুদিকে আঁখ, সর্ষের চাষ। ডুবে যাওয়ার আগে ক্ষেতের মাথায় টকটকে লাল পূর্ণ গোলক শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে অপরূপ গ্রাম্য দৃশ্য রচনা করে দিয়েছে। এখানেই এক বাঁশ বাগানের মধ্যে বাউল ফকিরি লোকগানের উৎসব। মিলনমেলা আয়োজন করেছেন স্বনামধন্য বাউল শিল্পী অর্জুন ক্ষেপা, তাঁর অনুগামী ও সংগীত অনুরাগীরা। দাদু ক্ষেপা মঞ্চে চলছে পালাগান। সামনে বিছানো ত্রিপলে বসে গাঁয়ের মেয়ে পুরুষেরা। মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে উঠে পড়ে গায়িকার হাতে দশ বিশ টাকা দিয়ে আসছে। বিনয়ের সঙ্গে তা গৃহীত হচ্ছে। সে গান শেষ হতেই শুরু হবে বাউল দেহতত্ত্ব গান, মহাজনী পদ। নামী শিল্পীরা এসেছেন। কিন্তু চেনা যায়না। চালচুলো বেশ ভুষায় আড়ম্বর নেই। গান চলবে মাঝ রাত অবধি। তারপর হবে মিলন।
আমার হাতে অত সময় নেই। নিতান্ত বাবু মানুষ, এসেছি গ্রাম দেখতে। বাউল সংস্কৃতি একটু ছুঁয়ে যেতে। গিয়ে গিয়েই চেয়ার খুঁজেছি। মাটিতে বসতে চাইনি। কিন্তু গান যত এগিয়েছে মনে হয়েছে সামনের একসারি লোকজন আর আমার মাঝে কয়েক যোজনের ফারাক।
মাটির সাথে মঞ্চ এক হয়ে গেছে কিন্তু চেয়ারের বাবু তাকে ছুঁতে পারছে না।
তারপর চেয়ার ছেড়ে আমিও মাটি নিলাম। গান করতে উঠলেন কলকাতার শিল্পী জোৎস্না মন্ডল। শহরে তাঁর বড় গানের স্কুল। নানা জায়গায় বাউল গানের ওয়ার্কশপ করেন। ইউটিউবে অনেক ফলোয়ার। দুই ছাত্রী নিয়ে গাইতে এসেছেন। বাউল গাইলেন, ঝুমুর গাইলেন, হাসন রাজার পদ গাইলেন। লোকগানের প্রকার আর ইতিহাস নিয়ে দু এক কথা বললেন। ভারী মিষ্টি তার গলা। আমি তখন মাটিতে। রসেবসে সরেস হয়ে বসে। কিন্তু ভাবছি গান তো ভালই তবে কলকাতার শিল্পীর গানই যদি শুনতে হয় তবে নদের গাঁয়ের বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে বসে থাকা কেন?
তিনি শেষ করতেই যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে থেকে যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন তিনি এবারে গাইতে উঠলেন। নদীয়ার শিল্পী। আমি নড়েচড়ে বসলাম। পরিচয় দিলেন একটু ফ্যাসফেসে স্বরে। নাম তার গৌতম মিস্ত্রি। গাইবেন ভবা পাগলার পদ।
শুরু হলো গান। তারপর মিনিট কুড়ি ধরে তার কন্ঠ, গায়েকি, গানের কথা আর পরিবেশ ভাসিয়ে দিয়ে গেল আমার যত বাবুগীরি, অহংকার। আবেগ জমা হয়ে চোখে স্রোত নামলো। মনে হলো ওনার কণ্ঠে শুধু এই গান দুটো শোনার জন্যেই আরেকবার জন্ম নেওয়া যায়।
তারপর আর দাঁড়াই নি। ভালো জিনিস অল্পই ভালো। চলে আসার আগে একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম গৌতম মিস্ত্রি আমাদের পলাশীর লোক। এখানেই তাঁর আসবাবের দোকানে নিজে হাতে কাঠের কাজ করেন। অবসরে হারমোনিয়াম বাজান, আর করেন গান।
আমি পলাশীরই চেয়ারে বসা, কম্পিউটার চালানো প্রবাসী বাবু। কলকাতা দিল্লি বোম্বাই ঘুরে এসেছি কিন্তু তাঁর কথা এতদিন জানতে পারিনি।



মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন