আমাদের প্রথম প্রেমগুলো

আমাদের প্রথম প্রেমগুলো সবসময় যে দারুন অনুভূতির জায়গা থেকে শুরু হতো এমনটা নয়। বরং ইস্কুলের বন্ধু যারা ইদানিং প্রেম করছে তাদের মুখে গল্প শুনেশুনে, বেঞ্চে I Love You, "সিধু + দেবো" বা "তমা + সুদীপ" ইত্যাদি লেখা দেখে আমাদের কারোকারো মনে একটা হুজুগ জাগতো। "প্রেম করলে তো মন্দ হয়না" দিয়ে শুরু হয়ে সেই হুজুগ "প্রেমে পড়তেই হবে"তে গিয়ে দাঁড়াতো। তারপর গার্লস ইস্কুল বা পড়ার ব্যাচের যে মেয়েটা আমদের চোখে সুন্দরী, যার কোনো প্রেমিক আছে বলে শোনা যায়না তাকে লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে শুরু হতো স্বপ্ন দেখা এবং কিছুদিন পড়ে মনে হতো সে না থাকলে পুরো জীবনটাই নষ্ট।

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন জীবনের প্রথম সিগারেটটি টেনেছিলাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিগারেট টানি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে। জিনিসটা কোনো দিনই আমাকে খুব একটা টানেনি তাই নেশাটা হয়ে ওঠেনি। প্রেমে পড়ে যখন তাকে ঘিরে কল্পনা গুলো একটু একটু করে সাজাচ্ছি, দেখি সে আমার হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট কেড়ে নিয়েছে আর ঠোঁটের ফাঁক থেকে জ্বলন্ত সিগারেট সরিয়ে দিয়ে দুঠোঁটের উপর আঙ্গুল চেপে ধরে বলছে - আর নয়। আমার কল্পনায় তার চোখে তখন কি আকুতি! অথচ সিগারেট তখন আমি খাই'ই না। 

তারপর কত কত বছর যে ঠোঁটের উপর তার আঙ্গুলের কাল্পনিক ছোঁয়া রয়ে গেছে...

এভাবেই আমাদের প্রেমগুলো ছিল খুব নিষ্পাপ। একদম তাজা পাঁপড়ির মত। ঠোঁটে যে ঠোঁটও ছোঁয়ানো যায় - তখনও একথা আমরা ভাবতেই পারতাম না।

প্রতি ঋতুতে মনের ভাবগুলো বদলে যেত। 

শরৎ কাল, পুজোর মাস; প্রেমে পড়ার ঋতু। সে সময় মন জুড়ে ভর করত সাহস। যা হবে হোক ভেবে নিয়ে দুম করে বলে ফেলতে পারলেই মনে হতো - যাক, কিছু একটা কাজের কাজ করা গেল।

শীতে মনে হতো সে যেন পাশেই আছে। পড়ার ব্যাচের পিকনিক থেকে একলা নিভৃত মুহূর্ত গুলো মনে হতো তার উষ্ণতায় গলে গলে যাচ্ছে।

বসন্ত আর গ্রীষ্মের শুরু মানে ছুটি আর নতুন ক্লাসে ওঠার সময়। সে সময়টা তাকে একবার দেখার জন্য হু হু করে উঠত মন। কি অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখতাম তাকে নিয়ে!

বর্ষায় বুঝতাম দারুন মনখারাপ রেখে সে চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কারো কাছে।

অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছিলাম একবার। বাড়িতে তখন একটা ওয়াকম্যান হয়েছে। হেডফোন দিয়ে শুনছি বেস্ট অব হেমন্ত। নানা রকম গানের পর অন্তিম দুই গান - "অলির কথা শুনে বকুল হাসে" আর "এই রাত তোমার আমার"। শুনতে শুনতে কখন যে পৌঁছে গেছি নির্জন এক রাস্তায়; চাঁদ উঠেছে, চরাচর জুড়ে পাগল করা জোৎস্না আর হাওয়া। পথে শুধু সে আর আমি। হাঁটছি পাশাপাশি। দ্বিধায় তাকাতে পারছিনা মুখ তুলে, শুধু জানি সে পরেছে ধবধবে সাদা সুতোর কাজের চুড়িদার আর আমি একটা নীল জামা গায়ে। আমাদের মাঝে শুধু আমার সাইকেলটা। গান শেষ হলেই সে মিলিয়ে যাবে আর আমি ফিরে আসবো সাইকেল চড়ে।

এভাবেই প্রেমগুলো আমাদের অলীক স্রোতে ভাসিয়ে দিতে দিতে হুস করে একদিন কোনো এক ঘাটে বেঁধে ফেলতো। সেখানে পৌঁছে বুঝতাম নরম নরম জোৎস্না দেওয়া চাঁদ ডুবে গেছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর। পথ একটা দেখা যায় বটে তবে তাতে বিস্তর লোকজন। এই রোদেই বাকিটা হাঁটতে হবে জেনে উঠে পড়ি। দেখি একজন আমার জন্য দাঁড়িয়ে; হাতে একটাই ছাতা। বুঝতে পারি তার ছাতার নিচে দাঁড়ালে দোষ হবে না। এমনকি তার মুখের দিকে নির্দ্বিধায় চেয়েও থাকা যায়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা