স্টোয়েসিজম
১
আজথেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের কথা। গ্রিস দেশের রাজধানী এথেন্সে বাণিজ্য করতে আসার পথে সাইপ্রাসের এক সওদাগরের জাহাজডুবি হয়ে গেল। জাহাজ ছিল দামী দামী মালপত্রে ঠাসা। সওদাগর সব হারালেও নিজে কোনোক্রমে বেঁচে গেলেন। বাণিজ্যের মালপত্র নেই তাই বাণিজ্যও নেই। হাতে নেই টাকা পয়সা। নেই কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এমন অবস্থায় কর্মহীন হতাশ সওদাগর মনের দুঃখে এথেন্সের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়লেন একটা বইয়ের দোকানে। পড়া শুরু করলেন বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস নিয়ে। দোকানি লোকটা ভালো। বই না কিনেও পড়তে দিলেন। একটা শেষ হতেই হাতের কাছে আরেকটা এগিয়ে দিলেন। এভাবেই পড়তে পড়তে সওদাগর সক্রেটিসের চিন্তাভাবনায় গভীর ভাবে প্রভাবিত হলেন। ভীষণ দুঃখের মাঝে যেন দিশা খুঁজে পেলেন। মুগ্ধ সওদাগর তখন দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলেন - আচ্ছা এই সক্রেটিস লোকটাকে পাই কোথায় বলতে পারেন ?
দোকানদার পড়লেন মহা বিপদে। সক্রেটিসকে তখন কোথায় পাওয়া যাবে! তিনিতো তার বহু বহু বছর আগেই মারা গিয়েছেন। সওদাগরের আগ্রহ দেখে দোকানী আঙ্গুল তুলে রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা লোককে দেখিয়ে বললেন- দেখো বাছা সক্রেটিস তো এখন নেই। তুমি বরং ওই লোকটার সাথে কথা বোলো। উনি সক্রেটিসের শিষ্যের শিষ্য। ওনার নাম ক্রেটেস।
সওদাগর আর দেরি করলেন না। ছুটে গিয়ে ক্রেটেসকে বললেন - আমি আপনার শিষ্য হবো। ক্রেটেসও রাজি হয়ে গেলেন।
ক্রেটেসের অন্যান্য বহু শিষ্যের মাঝে এই মাঝ বয়সী সওদাগর কিন্তু হারিয়ে গেলেন না। সক্রেটিক দর্শনের তখন বিবর্তন চলছে। নানা মুনি তাতে তাদের মত অনুযায়ী সংযোজন বিয়োজন করছেন। তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন দর্শনের ঘরানা। এই সওদাগর ও তেমনই এক ঘরানার সৃষ্টি করলেন। যার নাম স্টোয়েসিজম বা স্টোয়েকবাদ। ওহো সওদাগরের নামটাই তো বলা হয়নি! স্টোয়েসিজমের প্রতিষ্ঠাতা এই সওদাগরের নাম জিনো। সাইপ্রাস শহরে জন্ম বলে ইংরেজিতে ওনাকে ডাকা হয় জিনো অফ সাইপ্রাস বলে।
২
জিনোকে নিয়ে আর দুচারটে কথা বলেই আমরা চলে যাবো তাঁর প্রচলিত এই দর্শনের মাঝে। বলবো আরো কিছু স্টোয়েক দার্শনিকদের কথা। আসলে জিনো প্রতিষ্ঠা করলেও এই দর্শন জনপ্রিয় হয় এই ঘরানার অন্যান্য বিখ্যাত দার্শনিকদের জন্য। তাদের কথা বলার আগে জেনে নেওয়া যাক এই দর্শনের এমন অদ্ভুত নামের উৎপত্তি কিভাবে।
জাহাজডুবিতে ধনসম্পত্তি হারিয়ে জিনো হয়েগিয়েছিলেন গরীব মানুষ। তারপর আবার দর্শনের পাঠ নিয়ে তিনি নতুন করে বড়োলোক হওয়ার দিকে নজরও দেননি। ওদিকে একদম নতুন দর্শন হওয়ায় রাজা রাজড়ারাও জানতেন না এর ব্যাপারে তাই একদম প্রথমের দিকে পৃষ্ঠপোষকতা ছিলোনা। এসব কারণেই অন্যান্য বিখ্যাত দার্শনিকদের মতো জিনোর নিজস্ব দর্শন নিয়ে আলোচনা করার জন্য কোনো আলাদা জায়গা বা স্কুলবাড়ি ছিল না। জিনো আর তার অনুগামীরা গ্রিসের এক আড্ডাস্থলে জড়ো হতেন। আড্ডার ছলেই আলোচনা চলতো। পাকা দেওয়াল ঘেরা সেই আড্ডার জায়গাটার দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা থাকতো গ্রিসের নানা পৌরাণিক যুদ্ধের ছবি। গ্রিসবাসীদের কাছে এর নাম ছিল "স্টোয়া পয়কিলে"
এই "স্টোয়া পয়কিলে" থেকেই স্টোয়েসিজম নামের উৎপত্তি। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে জায়গার নাম দিয়ে কেন? জিনোর নামেই তো এই দর্শনের নাম হতে পারতো! প্রথমের দিকে হয়েছিলও তাই। কিন্তু পরে স্টোয়েকরা বললেন - না আমাদের এই দর্শনের এখনো অনেক কিছু জানার বাকি, বোঝার বাকি। আমরা শিখছি। আমাদের শিক্ষকও সব জানেন এমন নয়। তিনি এমন দাবিও করেন না। তাই কোনো একজনের নামে এই দর্শনের নাম হওয়া বাতিল হয়ে গেল।
জিনো লেখালেখিও করেছিলেন। তাঁর লেখা সবথেকে গুরুর্ত্বপূর্ণ বইয়ের নাম রিপাবলিক। একই নামে সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটোও একটা বই লেখেন। জিনোর বইতে তার নিজের মতামত, দর্শন ও প্লেটোর বইয়ের সমালোচনা ছিল।
জিনো নিয়ে আর তেমন গুরুত্ব পূর্ণ কিছু জানা যায়না। তার অন্যান্য নানা লেখা কালের গর্ভে বিলীন।
৩
এবার আমরা জানবো স্টোয়েসিজম ব্যাপারটা আসলে কি।
গ্রিসে উৎপত্তি হলেও এই দর্শন ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিস থেকে প্রাচীন রোমে। এ এমন এক দর্শন যার চর্চা করতেন রাজা রাজরা থেকে সাধারণ মানুষ এমনকি দাসেরাও।
তিনজন বিখ্যাত স্টোয়েক দার্শনিক হলেন
সেনাকা দা ইয়ংগার - যিনি ছিলেন রোমের কুখ্যাত রাজা নেরোর শিক্ষক।
এপিকটেটাস- যিনি নিজে একজন দাস ছিলেন।
মার্কাস এরিলিয়াস :- রোম তথা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের একজন বলে এনাকে গণ্য করা হয়।
স্টোয়েসিজম দাঁড়িয়ে আছে চারটে ভিত্তির উপর।
ব্যবহারিক জ্ঞান : জটিল ও উত্তেজনাময় পরিস্থিতি যুক্তি দিয়ে বুঝে ও ধীর স্থির ভাবে সামলানো।
মিতাচার: জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সংযমী ও পরিমিতি বজায় রাখা।
সুবিচার : অন্যকে বা অন্যের ব্যবহারকে সঠিক ভাবে বিচার বিবেচনা করা। এমনকি সে দুর্ব্যবহার করলেও।
সাহস: জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সাহসের সাথে এগিয়ে যাওয়া।
এই সাহস নিয়ে বিখ্যাত রোমান স্টোয়েক সেনেকা বলেন - "কোনো কোনো পরিস্থিতিতে শুধু বেঁচে থাকাটাই সাহসের পরিচয় "
এসব কথা কি'আর আমরা জানিনা। তাহলে আর স্টোয়েসিজমের গুরুত্ব কোথায়। আসলে স্টোয়েসিজমের গুরুত্ব লুকিয়ে আছে এই চার স্তম্ভের মধ্যেই।
৪
ধরুন, কোনো ঘটনা নিয়ে আপনি খুবই চিন্তিত। চিন্তায় চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না। কোনো কাজে মন নেই। ভীষণ দুর্ভাবনায় আপনার হাত পা কাঁপছে। এই অবস্থায় আপনার কোনো বন্ধু আপনাকে কি পরামর্শ দেবে ? কিভাবে আপনাকে শান্ত করবে ? বন্ধু হয়তো বলবে - অরে চিন্তা নেই। সব ঠিক আছে। ভয় করতে নেই। দুশ্চিন্তা ছেড়ে সুচিন্তা করো। বন্ধু আশা যোগাবে।
আমরা যদি কোনো ইংরেজি সেলফ হেল্প বই পড়ি তাহলেও এই কথাই শুনবো । প্রায় প্রতি বইতেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা; পজেটিভ ভাবুন। দুশ্চিন্তা নয় সুচিন্তা করুন। তারা এই সুচিন্তা করার নানা পদ্ধতিও আপনাকে বাৎলে দেবে।
এর মধ্যে ভুল কিছু নেই। এসব আশাব্যঞ্জক কথা চিন্তা কাটিয়ে আপনাকে কিছুক্ষন বেলুনের মতো আশার জগতে ভাসিয়ে রাখবে। কিন্তু স্টোয়েকরা এই আশা জিনিসটার ঘোর বিরোধী। তাদের মতে আমাদের চারপাশে যা হচ্ছে তার সবই জগৎের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরী কোনো নির্দিষ্ট কারণ ও তার ফলাফল।দার্শনিক এপিকটেটাস বলেন এই বিশ্বে ভালো বা খারাপ বলে আসলে কিছু হয়না। আমরাই সব ঘটনাকে নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে হয় ভালো নাহলে খারাপ বলে চিহ্নিত করি। কেবল ভালো কিছু আশা করার বদলে স্টোয়েকরা বলেন সমস্ত সম্ভবনার জন্যই প্রস্তুত থাকতে। আর শুধু সেই ঘটনা নিয়েই চিন্তা করতে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।
একটা গল্প বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।
দার্শনিক সেনেকার কথা আগেই বলেছি। রোমে তাঁর এক বন্ধু ছিলেন। সেই বন্ধু একজন সরকারি আমলা। একবার তার নামে একটা মামলা হয়। বড় জটিল সেই মামলা। ফলাফল বিপরীত হলে আমলা তার সম্পত্তি , সম্মান সবই হারাবেন। হয়তো জেলেও যেতে হতে পারে। খুব দুশ্চিন্তায় তিনি সেনেকাকে একটা চিঠি লিখলেন। চিঠির উত্তরে সেনেকা তাকে লিখলেন -
বন্ধু ,
আমি বলতেই পারতাম তুমি চিন্তা করোনা। কেউ তোমার কিচ্ছু করতে পারবেনা। মামলা তুমি জিতবে। তোমার প্রতিপত্তিও বজায় থাকবে। কিন্তু এমন আশা না দিয়ে আমি বরং তোমায় বলবো বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো এই মামলা আর তার ফলাফলের কি কি সম্ভবনা আছে। তুমি হয়তো জিতে গেলে অথবা হারলে। তোমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলো। তোমার চাকরি গেলো। তোমার নির্বাসন হলো। কিন্তু ভেবে দেখো এতো কিছুর পরেও তুমি যে সেই তুমিই থাকবে। হয়তো শোয়ার জন্য নরম বিছানা আর বিরাট ঘর পাবেনা। হয়তো সুস্বাদু খাবারের বদলে পাবে কেবল পেট ভরানোর মতো কিছু। তোমার ভুঁড়ি কমে যাবে। পরিশ্রমে গায়ের রং তামাটে হবে। কিন্তু এতকিছুর পরেও তোমার অস্তিত্ব অটুট থাকবে। আমার বিশ্বাস এমন ঘটনা যদি ঘটে তাহলেও তুমি টিকে থাকবে। তুমি ঠিকই সামলে নেবে। যদি তোমার অস্তিত্বের জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে পারো। যদি শুধু নিজের জন্য সচেতন হও তাহলে দেখবে শুধু বাঁচতে গেলে এই সম্মান, সম্পত্তির প্ৰয়োজনটাও নেই। আর লোকে কি ভাববে তাই নিয়ে যদি তুমি চিন্তা করো তবে বলবো ওই নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথার কিছু নেই কারণ অন্যের চিন্তার উপর তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই।
স্টোয়েকরা ঠিক এই কথাই বলেন। বলেন জগৎ যেমন তাকে তেমন ভাবেই নিতে। আর যা কেবল আমাদের নিয়ন্ত্রণে শুধু তা নিয়েই চিন্তা করতে।
একজন রাজ শিক্ষক হয়েও সেনেকা খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
তার শিষ্য খামখেয়ালি, বিকৃতকাম নেরো কেবল ইচ্ছার বসে সেনেকাকে বাধ্য করেন পরিবারের সামনে আত্মহত্যা করতে। যখন শোকে মুহ্যমান তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান তখন সেনেকা ভীষণ স্বাভাবিক ভাবেই তাদের বলেন - এতে কাঁদার কি আছে ? আমি ওকে বুঝিয়ে নিরস্ত করতে পারিনি। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছায় আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে যেতে একদিন যখন হবেই তখন আজ হলেই বা ক্ষতি কি। তোমরা দুঃখ পেয়ো না
৫
এতো গেলো সেনেকার গল্প। এবার রোমের বিখ্যাত রাজা ও দার্শনিক মার্কাস এরিলিয়াস নিয়ে দুচার কথা জানা যাক।
বিখ্যাত ইংরেজ ইতিহাসবিদ ও লেখক জন ডালবার্গের ততোধিক বিখ্যাত উক্তি হলো "Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely. Great men are almost always bad men..."
এই কথাটা বোধয় মার্কাস এরিলিয়াসের ক্ষেত্রে খাটে না। উনিশ বছর তিনি রোমের শাসক ছিলেন। এই উনিশ বছরে তিনি অন্যান্য রাজাদের মতোই বিলাসব্যাসন, নারী, সুরায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর কথাই ছিল রোমের আইন। তাকে ঘিরে থাকতো পাত্র মিত্র অমাত্য। হুকুম তালিমের জন্য হাজারো চাকর আর মনোরঞ্জনের জন্য লাখো ব্যবস্থা। এমন অবস্থায় পড়লে আজকের শাসকের কি অবস্থা হয় তা আমরা মর্মে মর্মে জানি। কিন্তু মার্কাস ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তার আমলে দুটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সত্ত্বেও রোমের প্রভূত উন্নতি হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে রাজা তার সন্তানদের হারান।
রাজা ছিলেন নিঃসঙ্গ। তার মনের সাথী বলে কেউ ছিল না। তাই তিনি নিজের সাথেই কথা বলতেন আর নিজের জন্যই লিখতেন। এই লেখায় তিনি সব সময় নিজেকে বলতেন আমি যেন শুধু একটা জিনিস নিয়েই বিচলিত হই। আমার কর্তব্য। কোনোদিনও আমার কর্তব্যে যেন গাফিলতি না হয়। এভাবেই রাজা নিজেকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে মনে করাতেন।
তিনি লিখেছেন আমি জানিনা কালকের দরবার কেমন যাবে। কালকের ব্যাপার আজ আমার হাতে নেই। আমি হয়তো ভীষণ খারাপ কোনো সংবাদ শুনবো। হয়তো খুবই দুর্নীতিগ্রস্থ কোনো আমলার সাথে কাল বৈঠক করতে হবে। হয়তো খুব জটিল কোনো মামলার বিচার করতে হবে। কিন্তু আমি স্থির থাকবো। উত্তেজিত হয়ে অবিচার করবো না। যা ন্যায্য তাই আমি অনুমোদন করবো।
মার্কাস এরিলিয়াস লিখেছেন - ঈশ্বরের থাকার প্রমান যেমন আমি পাইনি তেমন তিনি যে নেই তেমন প্রমাণও নেই। যদি ঈশ্বর থাকেন তবে আমি নিশ্চিত তিনি জ্ঞানী। তিনি সবই বুঝবেন। বুঝবেন বলেই তিনি ঈশ্বর। তাই ঈশ্বর যদি থাকেন তাহলে পরলোকের ভার তার উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর যদি না থাকেন তবে পরলোক বলেই কিছু নেই।
তিনি আরও লেখেন - খুব কঠিন পরিস্থিতি নিয়েও ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা ক্রমাগত শিখছি আর আমরা নিজেদের যতটা ভাবি তার থেকে বেশি মানসিক ও দৈহিক শক্তি ধারণ করি।
একবার ভাবুন তো ! একজন নিঃসঙ্গ রাজা। যার মনের কথা বলার কেউ নেই। কারণ কেউ তার মতো ভাবেনা। তাই তিনি শুধু নিজেই নিজের জন্য লিখে গিয়েছেন। নিজেই হয়েছেন নিজের বন্ধু। প্লেটোর রিপাবলিক বইতে যে আদর্শ শাসকের কথা লেখা আছে মার্কস এরিলিয়াস তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মার্কাস এরিলিয়াস চেয়েছিলেন এই লেখাগুলো যেন তাঁর মৃত্যুর পরেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রোমের কোনো বিচক্ষণ অজানা লাইব্রেরিয়ান এর গুরুত্ব বুঝে তা বাঁচিয়ে রাখেন। মার্কাস এরিলিয়াসের লেখার ইংরেজি অনুবাদ আজও পাওয়া যায়। এই লেখার নাম মেডিটেশন।
৬
স্টোয়েসিজম কেবল আত্মকেন্দ্রিক দর্শন নয়। একটা সময় ছিল যখন রোমের আইনে দাসেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবেই দেখা হতো। সেনেকা তখন দাসেদের সাথে মানবিক আচরণের কথা বলেন। বলেন আমরা সকলেই সমান ও একই মানবিক দোষ গুন্ নিয়ে গঠিত। দাসে মালিকে বিভেদ নেই।
এই দর্শনকে নিষ্ক্রিয়তার দর্শন ও বলা যায়না। তবে এই দর্শনানুযায়ী কেবল সঠিক মানবিক গুন্ সম্পন্ন স্থিতধী মানুষেরাই সমাজের ভালো করতে পারেন।
স্টোয়েসিজম বেশ কিছু শতক ধরে গ্রিস ও রোমের জনপ্রিয় দর্শন ছিল। আগেই বলেছি এ এমন এক দর্শন যার চর্চা করতেন রাজা রাজরা থেকে সাধারণ মানুষ অথবা সমাজের একদম নিচের তলার দাসেরাও। খ্রিস্ট ধর্মীয় দর্শন আসার পরে ধীরে ধীরে স্টোয়েসিজম আগের জনপ্রিয়তা হারালেও এর আপ্তবাক্য গুলো আজও মানুষকে প্রভাবিত করে।
বহু শতক পরে দার্শনিক রাজা মার্কস এরিলিয়াসের লেখা মেডিটেশন বইটি ২৭ বছর ধরে কারারুদ্ধ বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেলসন ম্যান্ডেলাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে।
প্রবল জনপ্রিয় ম্যান্ডেলা মুক্তির পরে সাদাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে যেতেও পারতেন। বরং তিনি বলেন -যে অবিচার হয়েছে তাকে তো পরিবর্তন করা যাবেনা কিন্তু আমি ও আমার সমর্থকেরা দেখবো যাতে ভবিষ্যতে আর এমন অবিচার না হয়।
বৌদ্ধ দর্শন ও স্টোয়েসিজম প্রায় সমসাময়িক। বৌদ্ধদের নির্বাণ তত্বের সাথে স্টোয়েক দর্শনের এটাড়্যাকসিয়ার মিল পাওয়া যায় যা আসলে মনের সেই অবস্থার কথা বলে যেখানে পৌঁছালে বাহ্যিক কোনো ঘটনায় মানুষকে বিচলিত করতে পারেনা।
আজকের দিনের মনোবিজ্ঞানও স্টোয়েক তত্ত্বের সমর্থন করে। গত শতকের বিখ্যাত ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেলের লোগো থেরাপিও এই স্টোয়েসিজমের উপর দাঁড়িয়ে। ভিক্টর তাঁর বিখ্যাত মেন'স সার্চ ফর মিনিং বইতে নিজের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিদশা ও আলোচ্য দর্শনের চর্চা করে চরমতম কঠিন প্ৰতিস্থিতেও জীবনকে অর্থপূর্ণ করার কথা বলেন।
এভাবেই জিনোর প্রতিষ্ঠিত স্টোয়েক দর্শন বারংবার মানুষকে সঠিক দিশা দেখিয়েছে।
বহু বহু বছর পরে আমাদের প্রাণের কবিও একই কথা বলেছেন -
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।।
তথ্যসূত্র: ইউটিউব , উইকিপেডিয়া , গুগুল , https://www.philosophybasics.com
বইপত্র : মেন্'স সার্চ ফর মিনিং (ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেল) , মেডিটেশন (মার্কস এরিলিয়াস ), লেটার্স ফ্রম এ স্টোয়েক (সেনেকা)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন