একটি যাচ্ছেতাই গুল্প
১.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো আজকের দিনটা নষ্ট হয়ে যাবে যদি একটা ভালো গল্প পড়তে না পাই। এভাবে শুরুতেই দিনের উপর একটা সিদ্ধান্ত দেগে দিতে খারাপই লাগল কিন্তু কিছুতেই মন থেকে চিন্তাটা বের করতে পারলাম না।
বই আমি অনেকই পড়ি কিন্তু আমার কাছে বই তেমন থাকে না। আজকাল বইয়ের যা দাম, আমার তুচ্ছ পকেট মানিতে তা কুলোয় না। যাও বা একটা অধটা কিনে ফেলি তা ঠিক কারোর না কারোর পছন্দ হয়ে যায়। তারপর বই ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সেই পুরোনো প্রথার পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে। আজকাল তাই দু একটা যা কিনে ফেলতে পারি তা কিনে কিনেই ফ্রিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। ফ্রিজটার শেষ থাকের নীচে সবজি রাখবার একটা প্লাস্টিকের মুখ খোলা বাক্স আছে। সে বাক্সে বাকি সবার বাড়িতে তরি-তরকারি থাকে। আমাদের বাড়িতে বই। সবজি আমি প্রতিদিন বাজার করে অনি। ফ্রেশ।
ফ্রিজে তিনটে বই ছিল। দুটো গল্পের। এবছরই বইমেলায় কেনা। তার একটা বের করে বালিশের নীচে রেখে দিলাম গরম হওয়ার জন্য। ততক্ষনে বাজারটা হয়ে যাবে।
২.
বাজার করে ফেরার পথে হঠাৎ ধ্রুবর সাথে দেখা। দেখেই বলে - ভাই আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিবি?
ধ্রুবর সব কাজই ছোট কাজ।
হ্যাঁ, না'য়ের অপেক্ষা না করেই পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে-
এটার অডিও আউট খারাপ। হেডফোনে কিছু শোনা যাচ্ছে না। একটু সারিয়ে এনে দিস। এই নে হেডফোন। টেস্ট করে দেখে নিস।
বলেই সে ধাঁ।
আমার যদিও আজ কাজ নেই। কিন্তু কাজ না থাকলেই এর ওর ফোন সরিয়ে এনে দেওয়াও কোনো কাজের কথা নয়।
তাও ফোনটা সারাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখলাম বালিশ ঠান্ডা করে বইটা একটু গরম হয়ে উঠেছে। এবার পড়া যাবে।
৩.
গল্পটা একটা জায়গার। এক অদ্ভুত জায়গা। নাম তালতোড়। সে জায়গা পশ্চিমে। দুমকার কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে কোনোএক গ্রাম। কিন্তু কোন পথে সেখানে পৌঁছানো যায় তা কেউ জানেনা। কথক একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে থেকে মলিন একখান ডাইরি কিনে জায়গার নাম জানতে পারে। শেষে দুই বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পরে ফিরে আসে একজনই। অন্য বন্ধু সেই জায়গার খোঁজে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক বছর পরে সেই পুরোনো বইয়ের দোকানে কথক আবার এক ডাইরি খুঁজে পায়। সে ডাইরি তার হারানো বন্ধুর। লিখেছে সেই অজানা গ্রাম থেকেই।
গল্পটা পড়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলাম। ভালো গল্প বলে আসলে কিছু হয়না। কোনো কোনো গল্প কারোর কারোর ভালো লেগে যায়। এ গল্পটা আমার কেমন লাগল বুঝতে পারলামনা। কিন্তু একটা জায়গায় কথা মনে পড়ে গেল। অদ্ভুত এক জায়গা। সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে ইচ্ছা করেনা। আমরা সবাই একটা জায়গাকে খুঁজি। কেউ কেউ পেয়েও যাই। তারপর আর ফিরি না। বাড়ি ছেড়ে বিদেশে গিয়ে যেমন কেউ কেউ আর দেশে ফিরে আসেনা। কেউ ভিনরাজ্যে , অন্য শহরে চলে যায়। ফেরে না। সে জায়গার অনেক নাম। তালতোড়, সংগ্রিলা, এল ডরেডো, দিকশুন্যপুর।
আবার সেই জায়গার খোঁজেই আমরা ঘুরে বেড়াই। বেড়াতে যায়, তীর্থ করি। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন বুঝি যে এ আমাদের তালতোড় নয় তখন ফিরে আসি।
৪.
ফোন সারাতে ঘন্টা তিনেকের বেশি লাগল না। বইপত্র গুটিয়ে দোকানে গিয়েই শুনলাম ফোন ফিট। দোকানটা আমাদের চেনা। টাকা ধ্রুব দিয়ে দেবে।
আজকের বাকি গোটা দিনটাতে আমার করণীয় কিছুই নেই। গল্পটা ভালো না খারাপ তা বুঝিনি। তাই দিনটা সুতোয় ঝুলছে।
কিন্তু গল্পটা একটা জায়গার কথা বলে। হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে সে জায়গার কল্পনা করতে থাকি। ট্রেন লাইন সেখানে একটাই। দিনে একটা বা দুটো ট্রেন যায়, আসেও। গোটা কয়েক যাত্রী নামিয়ে ট্রেন সেখানে লাইন ধরে ডান দিকে বেঁকে যায়। তারপর তার ল্যাজটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতেই খেয়াল হয় প্ল্যাটফর্ম থেকে পাকদন্ডী পথ নেমে গেছে ঘন বনবীথির দিকে। একটানা ঝিঁঝি ডাকতে থাকে দিনের বেলাতেও। গাছে গাছে অজানা পাখি উড়ে উড়ে বেড়ায়। বন পেরিয়ে ধানি জমি। সবুজ হয়ে থাকা দিগন্তের মধ্যে অনেক দূরে দেখা যায় একটা দুটো বাড়ি।
নীলা এখানেই থাকে। লুকিয়ে আসবে সে। আজ এক বছর ওর সাথে দেখা নেই। সে আসবে বলেই আমিও যাচ্ছি।
গ্রাম বাংলার সামান্য এক স্টেশন। কেউ কেউ নামে মাঝে মাঝে। আজ যেমন একা আমাকেই নামিয়ে ট্রেনটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর প্ল্যাটফর্মের শেষে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলাম নীলা কে। এক বছর পরে। নীলা এসেছে। এক বছরে ওর চোখের দৃষ্টি যেন আরও ঘন হয়েছে। মুখে দখিন হওয়ার মত হাসি। পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুক আলো এসে পড়ছে ওর গায়ে তা যেন তখুনি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে কোথায়।
নীলা! এক বছর পরে।
নীলাকে দেখলে আমার বড্ড আফসোস হয়। আমি গান গাইতে জানিনা। কবিতা লিখতে পারিনা। ছবি আঁকতে শিখিনি। নীলার একটা ছবি যদি আমি আকঁতে পারতাম। তারপর সেটা দেখে ও মুগ্ধ হয়ে আমার চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিত!
ওর জন্যে ডাইরির ছেঁড়া পাতায় যদি একটা ছোট্ট কবিতা লিখতে পারতাম তাহলে নীলা আমার থেকে কেড়ে নিয়ে তা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখত।
গান গাইতে পারলে ওকে বলতাম
কথা দাও ভুলবে না। আমি তো ভুলব না।
নীলার চোখ ছলছল করে উঠত। আমার জন্য ওর গাল বেয়ে এক দু ফোঁটা অশ্রু গড়াত।
না এসব আমি পারিনা। আমি একটা নগন্য মানুষ। নীলার কাছে আমি কিছুই না।
তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। ডুবন্ত সূর্য রক্তিম হয়ে আসে। নীলা চলে যাবে। আবার কবে কোথায় দেখা হবে জানা নেই। ফিরতে হবে আমাকেও।
নীলা কি বুঝতে পারে আমি ওর জন্য মনে মনে ছবি আঁকি। কত শব্দহীন কবিতা আমি ওকে উৎসর্গ করি। হারানো সুরে কত গান আমি গাই। নীলার সাথে আমার আর দেখা হবে কি? আবার এক বছর বা আবার বছর কুড়ি পরে? জানিনা।
নীলা চলে যেতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। বাঁশি বাজিয়ে শেষ ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। আমি উঠে পড়ি।
৫.
কিরে গান বাজছে ঠিকঠাক। ধ্রুব জিজ্ঞেস করে।
-হ্যাঁ পুরো ফিট।
-তুই তো একটা নিলেই পারিস। আচ্ছা দাঁড়া আমি তোকে একটা গিফট করব।
নাহ। বছর কয়েক পরে আবার খারাপ হলে আমাকে দিস। সরিয়ে এনে দেব। শুধু আমার বইগুলো ফেরৎ দিলেই চলবে
(ছবিটা তুলেছেন সাগর বোস। তার ফেসবুক পোস্ট থেকে তাকে না জানিয়েই নেওয়া। আশা করি অপরাধ নেবেন না)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন