মামার বাড়ি
মামারবাড়ি যেতে আমার কোনো দিনই ভালো লাগতো না। ইট পাথরের দাঁত মুখ বের করা পুরোনো একটা বাড়ি। উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় গা ছমছম করে উঠতো। বিরাট এলাকা জুড়ে বাড়ির আশেপাশে ভেঙে পড়া ইটের স্তূপ। সেসব জায়গায় যাওয়া মানা। সাপ খোপ আছে। আর ছিল কলাবন, বাঁশবন, পুকুর, আম কাঁঠাল খেজুর তালের ঘন বাগান। এসব নিয়ে একটা সাত আট বছরের বালকের কি'বা করার থাকতে পারে। সে তখন পাড়ার ছেলেদের সাথে বিকেলে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলে মাঠে। ছুটির সকাল কেটে যায় লুকোচুরি, কুমিরড্যাঙা খেলতে খেলতে।
মামার বাড়িতে এসব ছিলনা। আশেপাশে যেসব বাচ্চারা ছিল তাদের চিনতামই না। তারাও আমাদের সাথে ভিড়ত না। যতই হোক "বাবুদের বাড়ির ছেলে"!
তাদের জামা কাপড় ছেঁড়া , প্যান্টুলুনে বোতাম নেই, নাক দিয়ে সিকনি গড়ায়।
আর আমাদের গায়ে প্রতিদিন আলাদা আলাদা রংবেরঙের জামা। তার কোথাও ফুটিফাটা নেই। গলায় টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটিল স্টার। হাতে MRF স্টিকার দেওয়া ব্যাট। মুখে বিগ বাবল।
ওদের ড্যাঙগুলি বা টিপ্পি খেলা আমরা বুঝতামনা। ওরাও আমাদের আড় চোখে দেখে এড়িয়ে যেত। সঙ্গী হতো না। বড়রা "অজাত কুজাতের" সাথে খেলতে নিষেধই করতো।
আর যেটার অভাব ছিল তা হলো ইলেকট্রিক। প্রতিদিন রাতে আমাদের বাড়িতে কারেন্ট গেলেও জানতাম ঘণ্টা তিন চারেকের মধ্যে তা ফিরবে। তারপর ঘর আলো হবে। চিত্রহারে গান শোনা যাবে। আলিফলায়লা, ছুটির দিন সকালে শ্রীকৃষ্ণ, শক্তিমান। গরমের ছুটিছুটি তে "অরুণ বরুণ কিরণমালা"। মামারবাড়িতে এসবের সুযোগ ছিলনা। যদিও ইচ্ছা করলে ব্যাটারি এনে বা ভাড়া করে টিভি দেখা যেত। কিন্তু সে ইচ্ছাটাও এতটাই ঐচ্ছিক যে ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ অথবা কোনো বিরল রবিবারে ডিডি ৭ এ বাংলা 'বই' দেখা ব্যতীত তা অবলীলায় অবহেলা করা যেত।
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে মানুষগুলো চিনেছিলাম। মামার বাড়ির বিরাট চত্বরে ফাইফরমাশ খেটে দিতে 'প্রজা' কাশি ঘোষকে বসানো হয়েছিল কোনকালে। সেই কাশি মামার বৌ ঘড়া ঘড়া জল তুলে, তরকারি কেটে, বাটনা বেটে তবে নিজের বাড়ির রান্নায় যেত। বিকেলে কখনো তার মা এসে মুড়ি ভেজে দিতো। কাশি মামার তিন মেয়ে। বুঁচি, মলি আর ঝুমা। শুধু ওদের সাথে খেলায় একটু ছাড় ছিল। ওরা মাটি দিয়ে পুতুল গড়ত। পাতা দিয়ে বাঁশি গড়ত। কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে তীর ধনুক। ছাগল নিয়ে ওরা আম কাঁঠালের জঙ্গলে চড়িয়ে বেড়াতো। আমিও ওদের সাথে সর্ষে ভুঁইয়ের পাশে, বেগুন ক্ষেতের আলে আলে বেড়িয়ে যখন ধুলোমাখা আর চোরকাঁটা বোঝায় জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, ভাঙাচোরা অট্টালিকা তখন যেন খুব একচোট হেসে জিজ্ঞাসা করতো "কেমন দেখলে দাদুভাই?"
এই বাড়িটাই রাত্রে কেমন যেন বদলে যেত। সূর্য টুপ করে ডুবে যেতেই কালো হয়ে আসতো কামিনীতলা। বাড়ির দেওয়ালগুলো থেকে প্রেত মূর্তির মত অন্ধকার বেরিয়ে আসতো। সেই অন্ধকার নিষ্ঠুরের মত শেষ বিকালের দুর্বল আলোটুকু গিলে খেত। গা ছমছম করে উঠত। রাখাল হেট্ হেট্ করতে করতে গরুগুলোকে চড়িয়ে এনে গোয়ালে পুরে দিনের খোরাকি বুঝে ছুটি নিতো।
তখন রান্না ঘরে কুপি জ্বালত দিদা। বাকি ঘরগুলোর জন্যে হ্যারিকেন। সেই অকিঞ্চিৎকর আলোয় অন্ধকারই যেন আরও প্রকট হয়ে উঠত। নিম গাছের মাথায় তখন গুবগুব করে পেঁচা ডাকত। দিদা বলতো কালপেঁচা। অলুক্ষুনেটাকে তাড়া এখুনি।
বাড়িথেকে আনা বই পড়ে আর ছুটির কাজ করে খুব ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়তাম। ডেকে ডেকে তুলে মাসিরা গরম গরম দুধ দিয়ে মাখা ভাত মুখে পুড়ে দিত। তারপর মা, মাসি দিদা সবার জন্যে ঢালা বিছানায় ঠিক মায়ের কোলটি ঘেঁষে ঘুমিয়ে যেতাম।
এই 'একঘেয়ে' দিনগুলো যেন কিছুতেই কাটতো না। মা মামারবাড়ি আসার এক বেলা পর থেকেই তাই বাড়ি যাব বাড়ি যাব করে ঝামেলা জুড়তাম। মা প্রথমে বোঝাতো তারপর রেগে যেত। চড় থাবড়া দিয়েও যখন কাজ হতো না তখন মামারা সাইকেলে করে গ্রামের বাজারে বেড়াতে নিয়ে যেত। তা সে বাজার কোথায় লাগে আমাদের বাজারের কাছে। একটা ব্যাটবলের দোকান নেই! কোথাও স্টিকার পাওয়া যায়না। কিন্তু তাতে পাঁচ পয়সার আঁচার পাওয়া যায়। পাকিয়ে ঘুরিয়ে দিলে অনেক দূর উড়ে যাবে এমন পাখা পাওয়া যায়। আমকুট, আমপাচক পাওয়া যায়। আঙ্গুল দিয়ে টিপলে টকটক শব্দ হবে এমন ছোট্ট টিনের যন্ত্র পাওয়া যায়। লাল লাল মিষ্টি মিষ্টি 'চেরি ফল' পাওয়া যায়। এমন অনেক কিছু কিনে কিছুটা শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে একটু পরেই আবার বায়না জুড়তাম বাড়ি যাওয়ার। শেষে মামারাও হতাশ হয়ে, রেগে বলতো 'সিপিএমের ট্যাঁশ' তৈরি হয়েছে। বাবা, মাকে নিতে আসলে সেসব কথা একেক করে বাবাকে লাগাতাম। দু একদিনে মাকে ফিরে আসতেই হতো।
আনন্দ যে কোনোবারই হয়নি এমনও নয়। খুব ঘটা হতো কোজাগরী লক্ষীপূজোর সময়। অন্ধকারের দানবের সাথে যুঝতে তখন হ্যাজাক জ্বালানো হতো। আলোই আলো হয়ে যেত পুরো বারান্দা। চড়কি তারাবাতি পোড়ানো, সাপ গুলি জ্বালানো, লম্বা পাটকাঠির মাথা চিরে তাতে কালিপটকা পুড়ে দূর থেকে ফাটানো। কালীপূজোর সময় নারকেলের মালার পেছনে মোটা পাটকাঠি দিয়ে হ্যান্ডেল আর সামনে মোমবাতি দিয়ে টর্চ বানানো, বড়বড় লোহার রেলিঙে মোমবাতি সাজানো। মা তো শুধু এই সময়েই মামার বাড়ি আসতে পারে, অন্য সময় আসার কি দরকার !!
তারপর কতকত বছর কেটে গেল। দাদু চলে গেল। দিদা চলে গেল। সব থেকে ছোট মাসিটাও চলে গেল। বাকি মামা মাসিদের বিয়ে হলো। আমি বড় হলাম। নিজেও মামা হলাম। আমার বোনও বাড়ির থেকে বেশি দূরে থাকে না। তবুও তার বাড়ি আসা হয়না ঘনঘন। আসলেও তার মেয়ে বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো বলে উৎপাত করে। চকলেট, কিন্ডার জয়ে ভোলে না।
কর্মসূত্রে আমিও বাড়ির বাইরে। শহরে থাকি। বড় শহর। উঁচু উঁচু বিল্ডিং। ওলা , উবের। এসি লাগানো ঝাঁ চকচকে শপিং মলে সবই পাওয়া যায় কিন্তু সেই পাঁচ পয়সার আঁচার মেলেনা। সুটেড বুটেড স্মার্ট মানুষের ভিড়ে আমিও আরেকজন হয়ে হারিয়ে যায়।
তবু আজও যখন মামারবাড়ি যায়, মনে পরে বুঁচি, মলি ঝুমার সাথে ছাগল চড়াতে যাওয়া। ভুঁই থেকে বেগুন তোলার দিন গরুর গাড়িতে করে ঝুরি ঝুড়ি বেগুন নিয়ে ফেরা। মায়ের পিটুনি থেকে বাঁচতে কাশি মাইমা বা পূর্ণ কালার বৌয়ের শাড়িতে লুকানো অথবা পদ্ম পুকুরের ধরে সেই আবহমান কাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪ মাথা ওলা খেজুর গাছ যার ৪টি মাথা তখনো ছিল...
প্রমাতামহের মত দঁড়িয়ে থাকা মামারবাড়িটা সময়ের করাল গ্রাসে ও নগরায়নের চেষ্টার চাপে আরও জীর্ণ।
যেতে এখনো ইচ্ছা করেনা। তবে এখন কারণ ভিন্ন








মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন