এক পাহাড়ি গ্রামের গল্প (চটকপুর)

 ১

উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার চটকপুর গ্রামটাকে বাইরের জগতের থেকে যারা আলাদা আর আড়াল করে রাখে তারা হলো এখানে পৌঁছানোর দুটো রাস্তা।

দার্জিলিং থেকে সিকস্থ মাইল হয়ে পৌঁছানো যায় আবার জলপাইগুড়ি থেকেও সোনাদা হয়ে এখানে আসার আরেকটা রাস্তা আছে।

দুটো রাস্তাই গ্রামটার কাছাকাছি এসে একসাথে মিলে গিয়েছে। ফেরার সময় দেখা যাবে একটা উঠেছে উপরে আরেকটা নিচের দিকে নেমে গেছে।

কিন্তু মানুষ বড্ড ঠ্যেটা জাত। এই এবড়ো খেবড়ো ভাঙাচোরা পথ পার হতে  রীতিমত পয়সা দিয়ে যখন তারা পা বাড়ায় তখন ভয়ানক হ্যাচকানি, মোচকানি, দুলুনি সঙ্গে করে সেই পথে ঢুকতে ঢুকতেই হুট করে উষ্ণতা বেশ কয়েক ডিগ্রি কমে যায়। ঝকঝকে খাড়া রোদ যেন ম্যাজিকের মত মিলিয়ে গিয়ে পড়ে থাকে ফিল্টার করা নরম, মোলায়েম আলো। সেই আলোয় সামনে চোখে পড়ে বিরাট বিরাট মহীরুহ গাছপালা। গায়ে তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্যাওলা ধরে গেছে।

 চলতে চলতে গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। আলো আরেকটু কমে আসে। রাস্তার ধারে, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে রংবেরঙের ফুলগাছ। একটা মাত্র গাড়ির ঘরঘর শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না। এই সময় থামতে হয়। যান্ত্রিক ঘর্ঘরানি থেমে গেলে শোনা যায় একটানা ঝিঁঝির ডাক। আর কোনো এক গাছের ডালপাতায় লুকিয়ে অপূর্ব সুরে ডেকে ওঠে অজানা এক পাখি। বৃথা তাকে খোঁজার চেষ্টা।

সেনচল অভয়অরণ্যের মধ্যে একটা ছোট্ট গ্রাম এই চটকপুর। একসময় কাঠ চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য ছিল। এখন বনবিভাগ আর কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কল্যাণে গড়ে উঠেছে ইকো ট্যুরিজম। পাহাড়ের উপরে ধাপ কেটে কেটে ঘরবাড়ি আর চাষাবাদ। পর্যটন শিল্পই এখানকার মানুষের মূল পেশা। কিন্তু বর্ষার সময় এখানে বেড়ানোয় সরকারি নিষেধ আছে। সে সময় চাষ করা সবজি কাছের সোনাদা বাজারে বিক্রি করে উপার্জন করতে হয়। 

জায়গাটা শান্তির। মোবাইলে সিগন্যাল থাকে না। ফোন আসেনা, যায়ওনা।  ইন্টারনেট চলার কোনো প্রশ্নই নেই। যন্ত্রটা আর চোখদুটোর সঙ্গে মনটাও কিছুটা রেহাই পায়। কোনো কোনো বাড়ির বারান্দা অথবা ছাদ থেকে দেখা যায় প্যানোরামিক ভিউ। গোটা গ্রামের রংবেরঙের বাড়িঘর, তাদের সবজির বাগান, পোষা মুরগি, কুকুর বিড়াল, গরু, পাইন, ঝাও গাছে ঘন হয়ে যাওয়া জঙ্গল।

জায়গাটা ঠান্ডার। রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় যখন ভীষণ গরম তখনও এখানে তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রির উপরে ওঠেনা প্রায়। শীতে বরফ আর বরফ। গায়ে হাম্পু ঝাম্পু পরে, মাথায় টুপি লাগিয়ে এক কাপ কফি আঙুলে ধরে দূরে তাকালে দেখা যাবে জঙ্গলের উপরে কুয়াশা আর মেঘ। তার আড়ালে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ার পরে কুয়াশা কেটে গেলে, মেঘ সরে গেলে তার দেখা পান কোনো কোনো ভাগ্যবান পর্যটক। টাইগার হিলের অরূণোদয়ও দেখা যায়। তারজন্য ভিউপয়েন্টে গিয়ে ভিড় করতে হয়না।

আমরা যখন এখানে এলাম তখন গ্রামটা পরিষ্কার থাকলেও দূরে মেঘ আর কুয়াশা। কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া গিয়েছিল তার ঠিক আট দিন আগে। বৃষ্টি হয়নি তাই আকাশ পরিষ্কার নয়। আমাদের না দেখেই ফিরতে হবে। কিন্তু শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়। উত্তরবঙ্গের আরেক আকর্ষণ তার রঙিন পরিবেশ। রংবেরঙের ফুল,অর্কিড, পাখি। রঙিন মানুষের পোশাক, ঘরবাড়ির দেয়াল, ছাদ।

বনের ভেতর এই গ্রামে মাঝে মাঝেই দেখা যায়, চিতা বাঘ, ব্ল্যাক প্যান্থার, হাজার রকম পাখি, ভাল্লুক আর সালামান্ডার।

শেষের জীবটি যাকে বলে জলজ্যান্ত বিস্ময়। প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এই সরীসৃপটির গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে কোনো বিচিত্র কারণে থেমে গিয়েছিল তাদের বিবর্তন। তারপর থেকে বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীটি জীবন্ত জীবাশ্ম।

বনের মধ্যে ট্রেকিং করতে করতে গাইডের কাছে আমরা শুনছিলাম এখানকার মানুষজনের কথা। তাদের জীবন জীবিকার গল্প। দেখতে পেলাম গ্রামের একমাত্র সরকারি নেপালি মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুল। ছাত্র আর শিক্ষক যেখানে মাত্র একজনই।

বন যত গভীর হচ্ছিল তত আশা করেছিলাম হয়ত কোনো বন্যর দেখা মিলবে। কিন্তু পাহাড়ের মাঝে একটা ছোট্ট পুকুরের কাছে চিতার বদলে গাইড আমাদের দেখাল  চিতার পড়ে থাকা শুকিয়ে যাওয়া কালো মল।

পুকুরটায় জল কমে এসেছে। গাইড বলল জল যতোই কমুক এ পুকুর কোনোদিন শুকিয়ে যায়না। আর আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো পুকুরের জল অন্য কোথাথেকে আসেও না। তাই যত বন্যপ্রাণী এলাকার অন্যন্য জলাধার শুকিয়ে গেলে এখানে আসে জল খেতে। বছরে একবার পূজোও হয়।

পুকুর বা পোখরির জল ঘোলাটে ময়লা। সেখানে নাকি প্রচুর সালামান্ডারের বাস। আমরা তাকিয়ে রইলাম জলের দিকে, আশেপাশে।  কিছুই দেখতে পেলাম না। 

এবার ফিরতে হবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়নি, সালামান্ডার পাইনি, পাখির ডাক শুনেছি কিন্তু দেখিনি। নিরাপদ দূরত্ব থেকে একটা চিতা বা ভাল্লুক দেখার অলীক আসা পূরণ হয়নি।

ফিরতে একটু মনটা খারাপই করছিল। এমন সময় কানের কাছে ফরফর করে একটা শব্দ হলো। তারপর দেখি কাঁধে এসে বসেছে একটা প্রজাপতি। এত্ত বড়। রঙিন!

বেশ খানিক্ষণ সে বিশ্রাম নিয়ে গেল আমার কাঁধে। 

তারপর যখন ফিরলাম, মনে হলো তার পাখার হলুদ রংটা আমার মনেও কিছুটা ছড়িয়ে গেছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা