লকডাউন

 

জানলার সামনে ঠিক দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে একটা বুড়ো পায়রা এসে বসে। তার পালকগুলো অগোছালো। কোথাও কোথাও উঠেও গিয়েছে। শীর্ণ দেহ। দেখে মনে হয় সে বহু যুদ্ধের ক্লান্ত সৈনিক। এতদিন খেয়াল করিনি। এ সময়ে অফিসে থাকি। শনি রবিবার সময়টা চলে যায় হয় ঘুম নাহলে খাওয়া অথবা কম্পিউটার ঘাঁটতে ঘাঁটতে।
ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়ালে সারি দিয়ে দেখা যায় এই এলাকার অন্যান্য আবাসন গুলো। কখনো কখনো দেখি আমার মতোই বন্দী মানুষেরা গ্রিলের উপর হাত রেখে বড় উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। গরম পড়েছে। ভীষণ গরম। কিন্তু এদেশে তো বৈশাখ মাস নেই তাই কালবৈশাখী হয়না। সূর্য ডোবে দেরিতে। ছটার পর ছাদে উঠলে স্নেহ মমতা মেশানো হাওয়া বয়। ওখানেই আমাদের পিজির বাকি বোর্ডারদের সাথে গল্প, কখনো গান , বাড়ি থেকে অফিসের কাজ আর ভাইরাস নিয়ে আলোচনা। এ আলোচনা একসময় থেমেও যায়। ছাদের উঁচু কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে দূরে চেয়ে থাকে কয়েকজন । ছোট্ট স্পিকার এনে কখনো গান চালানো হয়। কেউ কেউ লোহার মই বয়ে জলের ট্যাঙ্কির কাছে পৌঁছে যায়। ছাদ জুড়ে চলতে থাকে পায়চারি। ঠিক এমন সময় লাল হতে হতে টুক করে সূর্য ডুবে যায়। অন্য দিকে জলছবির মতো আবছা উঁকি দেয় নিষ্প্রভ চাঁদ।
এ এক প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সমবেত ভাবে ভালো থাকার প্রয়াস। আহার কখনো নুডুলস কখনো দুধ কর্নফ্লেক্স। মাঝে মাঝে অনলাইনে অর্ডার করা খাবার পৌঁছে দিতে যারা আসে, ছোঁয়া বাঁচিয়ে তাদের থেকে প্যাকেট নিয়ে অনেকটা ঝুঁকে একবার বাও করে এক মুখ হেসে থ্যাংক ইউ বলি মন থেকে। তারপর তাদের বাহনে চেপে চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় দৃষ্টি সীমার বাইরে এখনো কেউ কেউ জেগে আছে। তারা আমার ঠিকানাও জানে।
এ সময় কাব্যি করার নয়। চূড়ান্ত হুড়োহুড়ি, অটো, বাস, ট্রাফিক , ধুলো নেই ঠিকই তবু বাড়ি থেকে কাজ করা আছে। অবিশ্বাস, সন্দেহ আছে তাই প্রতি মুহূর্তে কি করছি তার ব্যাখ্যা , ক্লায়েন্ট মিটিং। বাদ নেই সেসব কিছুই। বিরক্ত অনেকেই ভাবছে এর থেকে অফিসে বসে কাজ করাই ভালো ছিল। তবে এই বিরক্তি তাদের যাদের হাতে কাজ আছে। তারা জানে কিভাবে কম্পিউটার চালাতে হয়। কিভাবে চোখা চোখা কথায় বুঝিয়ে আস্বস্থ করতে হয়। তারা এখনো অন্তর্জালে অর্ডার করলে টুক করে কেউ এসে পৌঁছে দিয়ে যায় রসদ।
কিন্তু যাদের সে ব্যবস্থা নেই। নেই ওয়ার্ক ফর্ম হোমের বিলাসিতা তাদের আমরা হাঁটতে দেখেছি। মাইলের পর মাইল। গ্রামের পর গ্রাম, শহর তারা হেঁটে পার হচ্ছে আধ পেটা খেয়ে, কাঁখে কোলে পুঁটলি আর শিশু নিয়ে। যেদিন আমরা মোমবাতি জ্বালালাম সেদিন এক বন্ধু জানালো তার দেশের বাড়ির গ্রামে অনেক বাড়িতে আজ ১১ দিনের কাজ। যারা হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো তাদের কেউ কেউ প্রচন্ড গরম আর পরিশ্রমে রাস্তাতেই ........
তবু আমরা মোমবাতি জ্বালিয়েছি , থালা বাজিয়েছি। অতি উৎসাহীরা পটকা ফাটিয়েছেন , ক্যানেস্ত্রা পিটিয়েছেন। ঢোল বাজানো থেকে রকেট বাজি কিছুই বাদ যায়নি। যদিও এর পেছনে মহান কারণ ছিল। আমরা দেশের ডাক্তার, স্বাস্থকর্মী ও এই ঘোর দুর্যোগে যারা জীবন হাতে দেশের জন্য লড়ছেন তাদের এভাবে কুর্নিশ করেছি। ভাবতে ভালোলাগে। ভালোলাগে যে দেশ একদিন শুধু সৈনিকের কাজকেই দেশসেবা ভাবছিলো তারই আজ স্বাস্থ্যকর্মী , সাফাইকর্মী,পুলিশ, ডেলিভারি এজেন্ট, নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের সাথে যারা যুক্ত তাদেরকেও দেশের সেবক ভাবতে শুরু করেছে।
এভাবেই যখন দেশে খাদ্যের অভাব হবে আমরা কৃষিকাজ কে দেশ সেবার মর্যদা দেব। শিক্ষার অভাবে শিক্ষককে দেশের সেবক বলবো। শ্রম যখন অপ্রতুল তখন আমরা পুজো করবো শ্রমিকের। শুধু একটাই দুঃখ, আমরা তবুও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সহনাগরিকের মর্যদা বুঝবো না যতদিন না টিভি থেকে কেউ তাঁর মনের কথা আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বললেই দেশের সেবা না বললেই নয়।
যারা এসময়ে আমার মতোই আটকে বা যাদের বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা ছিলোনা তারা যে খুব আনন্দে আছে এমন বলতে পারিনা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার ভ্রূকুটি কুটিল হয়ে উঠছে। আসছে বিপর্যয়। বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রা, চেনা ছন্দ, পরিকল্পনা। ভুপালের এক প্রবাসী বাঙালি থাকে আমার পাশের ফ্ল্যাটে। ৮ এপ্রিল তার বিয়ের দিনক্ষণ স্থির ছিল। বিয়ে আটকেছে। বাড়ি ফেরাও হয়নি। এখন তার মনে প্রশ্ন চাকরি থাকবে তো ? বললাম না থাকে একটা কিছু ঠিক পেয়ে যাবে। সে বললো তার পার্টনারের স্বপ্ন বিরাট চাকরি , বিপুল পারিশ্রমিক, ভ্রমণপ্রিয় এন আর আই পাত্র। চাকরি গেলে সেকি পারবে এমন আশা পূরণ করতে? আমার কাছে উত্তর ছিল না।
পিজির ৫তলার মারাঠি মেয়েটাকে সেদিন একা ছাদে বাড়ির সাথে কথা বলতে বলতে কাঁদতে দেখেছি। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচরে সেই কান্নার দৃশ্য যে কি বেমানান আর মর্মান্তিক তা বোঝানো যায়না।
আমিও শুনছি প্রিয়জনের গলা। কথা দিচ্ছি লকডাউন ফুরোলেই একবার যাবো। কিন্তু আদেও কি দেখা হবে ? নিভৃতে আবার কখনো একসাথে বসার সুযোগ পাবো? ট্রেনে বাড়ির আগের স্টেশনের কাছে একটা দহ আছে। রেল যখন গমগম করতে করতে তার উপরের পুল দিয়ে যায় তখন আমরা ব্যাগ পত্র নামিয়ে দরজার দিকে এগোয়। তার আগে বিস্তর আলোচনা। কতদূর ট্রেন এলো, স্টেশনে কেউ আসবে কিনা , পৌঁছে কি খাবো। কাছের মানুষগুলোকে আবার সেভাবেই পাবো না ফিরতে হবে কোনো বেদনা নীরব নিভৃত পুরীতে জানা নেই।


( লেখাটি যখন লেখা হয় তখন আমি কর্মসূত্রে হায়দ্রাবাদে। একটি আধুনিক পিজিতে লকডাউনে বন্দি হয়ে আছি। রোগের ভয়াবহতা তখন অজ্ঞাত। চারিদিকে ভয় আর ভয়। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। বহু মানুষকে এই রোগে স্বজন হারাতে দেখেছি নিজেও হারিয়েছি। আক্রান্ত হয়েছি , সুস্থও হয়েছি। জীবন আবার আগের ছন্দে ফিরেছে। কিন্তু সেই স্মৃতি আজীবন সঙ্গী হয়ে থাকবে। )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা