কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা (লেখক - কল্লোল)
২০১৭ কলেজ স্কয়ার বই উৎসবে প্রথম যখন বইটা হাতে নিয়েছিলাম মনে হয়েছিল নকশাল আন্দোলন নিয়ে আবার একটা বই। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা পড়েছি। কোনোটা পক্ষে কোনোটা বিপক্ষে। হাজার চুরাশির মা পড়া হয়ে গিয়েছে। "অন্তরঙ্গ চারু মজুমদার" নামের একটা বইতে চারুবাবু সম্পর্কেও কিছু জেনেছি। আবার রুনু গুহ নিয়োগীর সাদা আমি কালো আমি পড়ে নকশাল আন্দোলনের ঠিক বিপরীত ও নকশাল দমনে সরকারি পদক্ষেপের প্রধান বিখ্যাত/কুখ্যাত এক চরিত্রের চিন্তাধারার পরিচয়ও পেয়েছি। এ বইতে নতুন কিছু থাকবে এমন আশা করিনি তাই কেনা হয়নি।
এক বছর পরে বইটা কেনা হলো ও পড়ে ফেললাম। কেমন লাগলো বলার আগে আরো কিছু কথা বলেনি।
২০০৩ সালে ৪৮ বছর বয়সে যখন মেজ জেঠু মারা যান বাবা একদিন দুঃখ করে বলেছিল " ওকে জেলে স্লো পয়জনিং করেছিল। "
বাবার মনে তীব্র ঘৃণা ছিল কংগ্রেসীদের উপর। জেঠু ১৩ মাস বহরমপুর জেলে ছিলেন নকশাল করার অপরাধে। সেই ১৩ মাসে একটু একটু করে কাউকে বিষ দেওয়া তারপর ২৮-৩০ বছর পরে তার মৃত্যু। যুক্তি নয় তীব্র ঘৃণা থেকে বলা। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নকশাল আন্দোলন নিয়ে, বলেছিলো "ওদের লাইনটাই ভুল ছিল। খতমের লাইন। "
আমিও যেন কোথায় পড়েছিলাম চারুবাবু বলেছিলেন "শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত রাঙায়নি যে সে বিপ্লবীই নয়"
কোথাও যেন এক পক্ষের ওপর পক্ষের প্রতি তীব্র ঘৃণা। আদর্শের জন্য লড়াই কি কোথাও স্রেফ খুনখারাপি তে বদলে গিয়েছিলো? আন্দোলন দমনের নামে রাষ্ট্র কি প্রবল সরকারি সন্ত্রাস শুরু করেছিল ?
এর মাঝে কি কেউ ছিল না যারা নিরপেক্ষ ? অথবা যারা গর্বিত হতেপারে নিজেদের আন্দোলন নিয়ে আবার নির্দ্বিধায় নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পারে। বলতে পারে তাদের কথা যারা রাষ্ট্র ও নকশাল এদের কোনো দিকেই না গিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।
বিশ্বাস করুন এই বইটা না পড়লে জানতে পারতামনা ঘোষিত, প্রতিষ্ঠিত ডানপন্থী গৌরকিশোর ঘোষের কফি হাউসে কাছা পরে এসে এমার্জেন্সির জামানায় গণতন্ত্রের মৃত্যুতে অভিনব প্রতিবাদের কথা।
এই বই অন্ধ সমর্থন বা বিরোধী পক্ষের প্রতি তীব্র ঘৃণার আবেগে লেখা হয়নি। লেখক নিজেকে প্রতিবাদী বীর বিপ্লবী বলে প্রমান করার চেষ্টা করেননি। বরং পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে তার বুক কেঁপে যাওয়ার কথা নির্দ্বিধায় বলেছেন। বলেছেন সত্তরের কলকাতার প্রায় বিস্মৃত বামপন্থীদের কথা। এই বই লেখকের শেখার গল্প, দেখার গল্প, দিন যাপন ও উপলব্ধির গল্প বলে।
বলে ভারতের কমুনিস্ট আন্দোলের বহু ধারায় বিভক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হওয়ার শুরুর দিনগুলোর কথা।
রাষ্ট্রের গুলিতে শহীদের কথাও বলে আবার পুলিশি অত্যাচারে শেষ অবধি ভেঙে পড়া মানুষের আত্মগ্লানির কথাও বলে।
এখনো অবধি আমার পড়া গুরুচন্ডা৯র শ্রেষ্ঠ বই।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন