পশ্চিমে হাওয়া বদল

ঝাড়খণ্ডের গালুডি হয়ে যে রাস্তাটা পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে এগোলে দুধারে দেখা যায় দু রাজ্যের নানা প্রান্তিক গ্রাম। দূরে দূরে পাহাড় আর রাস্তার পাশে মাটির বাড়ি। উত্তরবাংলাতেও পাহাড় দেখা যায়। সেখানে সুউচ্চ পর্বত, সংকীর্ণ উপত্যকা। এ এলাকায় বিস্তীর্ণ উপত্যকার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু  পাহাড়, বাকিটা উঁচুনিচু টিলা, টাঁড় ভূমি। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে ধান উঠেছে সবে। ঘরের উঠোন, গোলায় গাদা করে রাখা। ঝাড়াই চলছে। কিছু বয়স্ক মানুষ যাদের হাতে তেমন কাজ নেই তারা উবু হয়ে বসে। চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। যেন বহু দিনের হিসেব নিকেশ মিলছেনা। গালুডি থেকে এই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে ডানদিকে দলমার জঙ্গল। বনের মধ্যে দিয়ে ঢালাই রাস্তা চলে গেছে বহুদূর। নাম না জানা অনেক গ্রাম আছে সেখানে যাদের খবর আমরা মাঝেমাঝে খবরের কাগজে পড়ি। যেখানে হাতি বের হয়। মানুষ খেতে পায়না অথবা পিঁপড়ের ডিম খায়। আধুনিক সুযোগসুবিধা থেকে যে গ্রামগুলো বঞ্চিত। দুই রাজ্যের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয় উন্নয়ন নিয়ে। এ বলে তোদের গ্রাম ও বলে তোদের। 

পরিস্থিতি ঠিক কতটা পাল্টে যেতে পারে তা আমরা জানি যদি এই গ্রামগুলো দুটো রাজ্যের বদলে দুটো দেশের মাঝামাঝি হতো। তখন কাড়াকাড়ি পড়ে যেত তাদের দখল নিয়ে।

ছোটনাগপুর মালভুমির এই এলাকায় শহর, গ্রাম, ল্যান্ডমার্ক, জনপদের নামগুলো থেকে রোম্যান্টিকতা চুঁইয়ে পড়ে। ধলভূমগড়, ঘাটশিলা, গালুডি, মাহুলডি, মৌভান্ডার, সুবর্নরেখা, রাতমোহনা, ফুলডুঙরি, ভালো পাহাড়, দুয়ারসিনি, কাজলী। নামগুলো যেন একটা প্রেমের উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে। সেই উপন্যাসে ক্লান্ত এক শহুরে বাবু ছুটি কাটাতে এসেছে পশ্চিমে। খুঁজে পেয়েছে এক নীরারম্বর জীবনের পথ। সেখানে প্রতি শনিবার হাট বসে। তুচ্ছ জিনিসের পসরা সাজিয়ে বিকিকিনি চলে। মোরগ লড়াই দেখে মানুষগুলো মেতে ওঠে। রাখঢাক, বাঁধাহীন পরিবেশ। মাটিতে বসে হাঁড়িতে করে দেশি মদ বেচে গাঁয়ের মেয়েরা। তাই সে দু গ্লাস ঢেলে দেয় গলায়। রঙিন হয়ে ওঠে তার জগৎ এবং খুঁজে পায় কাজলনয়না সরলমতি কোনো যুবতীকে। তার শহুরে মধ্যবিত্ত নীতি বোধের সীমারেখা ভেঙে নানা রকম ইচ্ছার বান আসবে তারপর। তবে একসময় তাকে ফিরে যেতে হবে। যখন সে ফিরবে তখন সেই সরলমতি যুবতী বুঝে যাবে ভালোবাসা কাকে বলে। মনের ভালোবাসা দেহের ভালোবাসা।

এসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাওয়া যায় একটা আদিবাসী লোকালয়ে। গ্রামের নাম ডোমাকাকোচা।  এলাকার আর পাঁচটা গ্রামের মতই। বড়লোকির নামগন্ধহীন মাটির বাড়িঘরের মাঝে ইতস্তত এক দুটো একতলা প্লাস্টারহীন পাকা ঘর। শীর্ণ শিশুরা রাস্তায় খেলছে। মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে দূরে দেখা যায় এক আদিবাসী প্রৌঢ়া বাড়ি ফিরছে। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু গ্রামের শেষপ্রান্তে রাস্তা যেখানে বাঁদিকে ঘুরে গিয়েছে সেখানেই দেখি একটা পিকচারেক্স।  শাল পিয়ালের বনের মাঝে ছোট্ট এক টুকরো জমিতে আরো ছোট একটা পুকুর। যেন মাটিতে ফেলেরাখা একখান আয়না। তাতে ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখছে তামাম দুনিয়া।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা