তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ (লেখক - কল্লোল )

 আমার মনে হয় পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে গেলে নিজেকে বই , বইয়ের চরিত্র , লেখক ও ঘটনার থেকে একটু নিরোপেক্ষ আসনে বসাতে হয়।

ধরুন একটা বই বেরুলো আর আপনি হামলে পড়লেন। আপনার প্রিয় লেখকের বই হতেই পারে। কিন্তু লেখা পড়ে হতাশ হলেন। প্রতিক্রিয়ায় তখন আপনার হতাশা ফুটে উঠবে মাত্রাতিরিক্ত। বইটা ভালো লেগে গেলে তেমনই মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছাস দেখা দেবে আপনার প্রতিক্রিয়ায়। এই আধিক্য কাম্য কখনোই নয় কিন্তু আবেগকে সামলাবেন কি করে?
কোনো ক্লাস নিতে বসিনি। আসলে আজকের এই লেখাও আধিক্য দোষে দুষ্ট হতে পারে তাই আগে থেকে বলে রাখলুম আরকি।
কল্লোল বাবুর "কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা" আগেই পড়েছিলাম। কেমন লেগেছিলো তা এর আগে একটা পোস্টে জানিয়েছি। "তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ" তার পরবর্তী গ্রন্থ। এক্সপেক্টেশন ছিলো কিন্তু তবু এক্সপেক্টেশনজনিত আবেগচ্ছাস সরিয়ে রেখে পড়তে শুরু করে দেখলাম এক অন্য আবেগ এসে মিশে যাচ্ছে।
গল্প শুনেছেন? দাদু ঠাকুমার মুখে গল্প , বন্ধুর মুখে তার জগৎ জয় করা কীর্তির গল্প বা কোনো দুঃখী মানুষের দুঃখের উপাখ্যান। পাতা উল্টে পড়তে হয়না , শুধু শুনে যেতে হয়। ভালো করে শুনলে দেখবেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে একের পর এক ছবি। ভালো কথক যদি হন তাহলে দেখবেন কোথায় এসব নিরপেক্ষতার কাগুজে বুলি !! কানে ঢোকা প্রতি শব্দের সাথে আপনি কখন যেন মিশে যাচ্ছেন ঘটনা আর চরিত্রের সাথে।
কল্লোলবাবু বই লেখেননি গল্প বলেছেন। নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা তছনছ হয়ে গিয়েছে।
কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতায় শেষ হয়েছিল। কথক জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। নকশাল আন্দোলন আশাতীত আশা জাগিয়ে আশানরুপ মুক্তি আনেনি। আত্মসমলাচনা চলছে। ভুল ছিল কোথায় । কি কি করার ছিল। কি কি হয়নি। রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে অকংগ্রেসি দল। সময়টা ৭৭ এর শেষ থেকে এই ধরুন ৯৮ অবধি (এই সময় নিয়ে এর আগে কোনো বই পড়িনি)।এ সময় আত্মতৃপ্তির, নতুন করে গড়ে তোলার অথবা ব্যর্থতায় ভেঙে যাওয়ার। ৭০এর শেষের দিক আর ৮০ দশকের শুরুর কলকাতার অলিগলি। শহরের আনাচে কানাচে বহু বামপন্থী কিন্তু ভিন্নমতাদর্শী মানুষেরা। চোলাইয়ের ঠেকের মালিক থেকে নতুন সরকারের মন্ত্রী। এই কলকাতা আর মানুষ , মানুষ, মানুষ।
বাম দল সরকারে এলো আর মেহনতীরা অধিকার পেলো। এতো সোজা ছিলোনা সব। লড়তে হয়েছে অধিকার ছিনিয়ে নিতে আবার মেদিনীপুরের গ্রামে।
কলকাতায় টিভি এসেছে। আর বিশ্বকাপ ফুটবল। শৈল্পিক থেকে সাবধানী ফুটবল। মারাদোনা থেকে ফুটবল দার্শনিক সক্রেটিস।
মিটিং, মিছিল, বোমাবাজির মাঝে রুখে দাঁড়ানো আর এক অপার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে, নত হয়ে, জানা , বোঝা ও মত বিনিময়। কল্লোল বাবু গল্প বলে গিয়েছেন।
কালের কতটুকু দেখেছি যে এই বই কালজয়ী হবে কিনা বলবো ? তবু এ এমন এক গল্প যা মনে থেকে যাবে বহু বহু দিন। বলবে আদিগঙ্গার গা ঘঁষে শ্মশানের ধারে গোশালার পাশের কোনো এক ভাঙাচোরা টালির চালের ঘরে থাকা সুরেশ বিশ্বাসের কথা যার গান শুনে স্বয়ং হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন "এই মানুষবাসের অযোগ্য জায়গায় থেকে যে মানুষ এমন গান গাইতে পারেন, তাকে আমি প্রণাম করি"। বলবে বাড়ি থেকে পালানো যাদবপুরের ইংরেজির ছাত্র মঙ্গুর ভবঘুরে জীবনের কথা যে কথার খেলায় মানুষের পরম বন্ধু হয়ে হঠাৎ অল্পকিছু হাত সাফাই করে হাওয়া।
গল্প যত এগিয়েছে এসেছে গান। মুক্তির গান , বেঁচে থাকার গান, বিশ্বাসের গান। দেওয়াল লিখন থেকে সিনেমা , নাটক। চার্লি,ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃনাল, বিজন , মনোজ, রুদ্রপ্রসাদ।
বাংলার ঠেকে শক্তি চট্টোপাধ্যের কবিতা পাঠ -- আধেক লিন হৃদয় দূরগামী / ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি / সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া / অবনী বাড়ি আছো....
ঠেকের শ্রোতা বিড়বিড় করে বলেছে - "এতবার ডাকলেন হারামী সাড়াই দিলো না!!!"
৮৫ এর কলকাতা পৌরসভা ভোট। বয়কট না অংশগ্রহণ দোলাচল কাটিয়ে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত। হয় জয় না হয় পরাজয়। সেতো ফলাফল। গল্প হলো আসলে মাঝের লড়াইটুকুর। তারই গান
লড়াই করো / লড়াই করো লড়াই / যতদিন না বিজয়ী হও / যদি একবার হারো বারবার / লড়ো বারবার / লড়ো বারবার / যতদিন না বিজয়ী হও ...
একি ঠিক পাঠপ্রতিক্রিয়া হলো নাকি কেবল আবেগের প্রকাশ ?
সে যাইহোক শেষে আমিও বলি মেদিনীপুরের পরিবহন শ্রমিকদের ভাষায় - কি লিখেছেন কল্লোন দা!! কি লিখেছেন। ...
তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ
লেখক: কল্লোল
গুরুচন্ডা৯


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা