একটি হাটের রচনা

ধুধুম ধুধুম ধুম ধুম, ধুধুম ধুধুম ধুম ধুম শব্দ করিয়া বাদ্য বাজিতেছে। পড়ন্ত  বৈকাল। বিষ্ণুপুর ছিন্নমস্তা মন্দিরের নিকটস্থ প্রান্তরে সাপ্তাহিক হাট বসিয়াছে। পোড়া মাটির হাট।  হাটের কেন্দ্রস্থলে কিঞ্চিৎ সাঁওতালি গ্রাম্য আভাষ অনিবার অভিপ্রায়ে নৃত্য চলিতেছে।  শহুরে বাবু বিবিরা এই স্বাদের অন্তিম বিন্দু অবধি শুষিয়া লইতেছেন।  ছবি ও ভিডিও রেকর্ড করিবার  যন্ত্র সহকারে উপস্থিত হইয়াছেন। কষ্ঠিপাথর কোঁদা মূর্তির ন্যায় নানা বয়সী কিছু সাঁওতাল রমণী উগ্র সবুজ ও হলুদ শাড়ি পড়িয়া ছন্দে ছন্দে পা মিলাইতেছে। প্রত্যেকের মস্তকে একজোড়া সজ্জিত ঘট। একটির উপর আরেকটি।  তাহাদের কাহারো মুখে হাসি নাই ছিটেফোঁটাও । সাঁওতাল পুরুষেরা যন্ত্রের মতো ঝুমঝুমি ও তালবাদ্য বাজাইতেছে।  পাশবর্তী এক বাবু তাহার শিশু পুত্রকে বলিলেন -ওটাকে ধামসা  বলে। পুত্রের মাতা তৎক্ষণাৎ  কহিলেন -না ওটা মাদল।

নৃত্য অবিরাম চলিতেছে । এবারে পা মিলাইলেন কয়েকজন কলিকাতার মেমসাহেব। নাচিতে নামিবার পূর্বে তাহাদের একজন কহিয়াছিলেন - "দিস ইজ সো বিউটিফুল! না শওরব ? ইউ টেক ফ্রম দ্যাট এঙ্গেল।"

উহাদের গাত্রে শীত বস্ত্র নামমাত্র।

উদ্ভিন্নযৌবনা মেমসাহেবেদের উপস্থিতিতে মেলা চত্বরে উষ্ণতার পারদ চড়িতেছে। তাহাদের উন্মুক্ত বহু, অনাবৃত পৃষ্ঠ হইতে ডুবন্ত সূর্যের দুর্বল আলোও যেন পিছলাইয়া পড়িতেছে।  বহু ডি.এস.এল.আর ধারী সেদিকেই লেন্স তাক করিয়াছেন।  মুঠোফোন হইতে সে দৃশ্যাবলী ফেসবুক লাইভে জগৎ মাঝারে ছড়াইয়া যাইতেছে।

মাঠের কোথাও বাউল গান করিতেছেন। মাইকের আওয়াজ, পরিযায়ী যুবকযুবতীর গিটার সহযোগে গান, ধামসার শব্দের মিলিত কোলাহলে তা প্রায় শ্রুতিগোচর হইতেছে না।

হাটস্থ বিপণিগুলিতে নানা জিনিসের সম্ভার। চিত্রিত লণ্ঠন, পট। পোড়ামাটির- পেয়ালা, পিরিচ, ঘোড়া, শ্রীদুর্গা , রাধাকৃষ্ণ, নৃত্যরত বাউল, বিখ্যাত দলমাদল কামানের ক্ষুদ্রাকৃতি স্মারক, মাটির শঙ্খ, বোতল, ফুলদানি। কাঠের -ঘোড়া , মৃগমুখ, গণেশ মুখ, অন্যান্য গৃহ সজ্জার উপকরণ। খাবার দোকানে পাঁপড়, জিলিপি, চপ, ঘুগনি ও বিষ্ণুপুরি মোমো। বস্ত্রের দোকানে বিশেষ ভাবে কারুকার্জকরা চাদর, সিল্ক , বাটিক, বালুচরি। তবে কোথাও বাঁকুড়ার বিখ্যাত ডোকরা শিল্পসামগ্রী দেখা যাইতেছে না। কারিগরের অভাব না ক্রেতার তাহা গবেষণার বিষয়।

হাট ধারণকারী প্রান্তরের অপরপ্রান্তে জোড় মন্দির শ্রেণী। সে স্থানেও কিছু মানুষ আসিয়াছেন। বয়স্করা শ্রদ্ধাহেতু পাদুকা খুলিয়া মন্দির চাতালে উঠিয়া পায়চারি করিতেছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠিতেছে ইহাই কি ছিন্নমস্তার মন্দির। কিন্তু মন্দির অভ্যন্তরে কোনো মূর্তি নাই বলিয়া কপালে হাত ঠেকাইয়া অদৃশ্য দেবীর উদ্দেশ্যে মন্দিরকেই প্রণাম করিতেছেন। যুবতীরা মন্দির গাত্রে এলাইয়া পড়িয়া প্রগলভ পোজ দিতেছেন। যুবকেরা তাহা ক্যামেরাবন্দি  করিতে ব্যস্ত।

মন্দিরগুলি একরত্ন। বয়স প্রায় তিনশত বৎসর। কোনো এক সময় মন্দিরগাত্রে নাকি পৌরাণিক কাহিনী পোড়ামাটির অলংকরণে চিত্রিত ছিল। বয়সের ভারে তাহা মিলিতপ্রায়।

আজকের হাটে আসিয়াছে নিয়তিতাড়িত সাতজন যুবক। নিয়তিই বটে। না হইলে অর্থ দিয়া নিশ্চিতকরণের পরেও তাহাদের পুরুলিয়া ভ্রমণ ভেস্তে যাইতো না। তাহারা এসময় সুরাপান করিতে করিতে ঘোলাটে চোখে পাহাড়ের খাঁজে সূর্যাস্ত দেখিবার প্রয়াস করিত। বিষ্ণুপুরের মন্দির ও তৎগাত্র সংলগ্ন পোড়ামাটির কারুকার্যে তাহাদের বিশেষ আগ্রহ নাই। তাহারা আর কিছুক্ষন পরে হাটস্থ দোকানিদের সঙ্গে দরাদরি করিবে ও অন্য যেকোনো হস্ত শিল্পমেলায় যে সমস্ত সামগ্রী সহজেই পাওয়াযায় তাহাই সুলভে কিনিবার প্রয়াস করিবে। বিপুল লোকসমাগমের মধ্যে তাহাদের আলাদা করিয়া চিনিবার চেষ্টা বৃথা ও অপ্রয়োজনীয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা