মায়াচর

 ১.

ছোটবেলায় ঠাকুমা যখন বেঁচে ছিল তখন আমাদের বাড়ি আত্মীয় স্বজনদের আনাগোনা ছিল খুব। তারা সবাই যে খুব নিকট আত্মীয় তা নয়। দূরসম্পর্কের আত্মীয়রাও নির্দ্বিধায় ঠাকুমার সাথে দেখা করতে আসত। এসে দু চারদিন থেকে যাওয়ারই নিয়ম ছিল। আজ এসে কাল চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক নজরে দেখাও হতো না। কেউ যেতেও দিত না। তখন মোবাইলের যুগ নয়। পাড়ার কোনো কোনো বড়লোকদের বাড়িতে হয়ত একটা ল্যান্ডফোন থাকত। তাতে লাইন পাওয়াও দুষ্কর ব্যাপার। যে সমস্ত অতিথিরা আসতেন তদের কেউ কেউ হয়ত আগে থেকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই চিঠি সঠিক সময়ে এসে পৌঁছাত না। তাই আমাদের কাছে তাদের আকস্মিক আগমনই ঘটত।
এখন যুগ বদলেছে। অপ্রয়োজনে সহজে কেউ কারোর বাড়ি যায়না। গিয়ে থাকার তো প্রশ্নই নেই। আর যাওয়ার আগে তিথি নক্ষত্র জানিয়ে দেওয়াই বর্তমানের দস্তুর।
এ ব্যাপারটা ভালোই। গৃহস্বামীকে বিব্রত হতে হয়না। দু চার ঘণ্টায় প্রয়োজনীয় আলাপচারিতা দিব্যি সেরে নেওয়া যায়। সেই ফাঁকে অল্প স্ন্যাকস। বড়জোর লাঞ্চ। তারপর সৌজন্য বিনিময় শেষে ঘরে ফেরার পালা।
আমি আজকালকার এই নিয়মকে একটু নিজের মত ভেঙে নিয়েছি। কারোর সাথে দেখা করতে গেলে পারতপক্ষে তাকে জানাই না। হঠাৎ অকারণে আবির্ভূত হই। এতে কেউ কেউ খুব আনন্দ পায়। কেউ খুব বিরক্ত হয়। কেউ বেশ চমকে উঠে চিন্তায় পড়ে যায়। আমি তাদের অভিব্যক্তি দেখে মানুষ গুলোকে নতুন করে চিনতে চেষ্টা করি। তারপর চা টুকু গ্রহণ করে বিদায় নি। থাকি না।
২.
সেদিন আমার যাওয়ার কথা ছিল মায়াচর। জায়গাটি পূর্ব মেদিনীপুরে। রূপনারায়নের বুকে জেগে ওঠা একটা দ্বীপ গ্রাম। মায়াচর আমি কখনো যায়নি। কিন্ত কোথাও শুনেছিলাম কলকাতা থেকে দীঘা বা হলদিয়ার কোনো বসে চেপে তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। ধর্মতলা থেকে দীঘার NBSTC বাস ধরলাম। স্টপেজের নাম জানা নেই। পাশের সিটের যাত্রী বলতে পারলেন না। এদিকে আমার হাতে মাত্র দুশো চল্লিশ টাকা। ঘুরে কলকাতা ফিরতে হবে তার মধ্যেই। সেখান থেকে বাড়ি যেতেও বেশ কিছু খরচ। অতএব বাসের ভাড়া বাবদ সত্তর টাকার বেশি দিলে অসুবিধা। যেতে সত্তর আসতে সত্তর। বাকি একশ টাকায় খুচরো খরচ চালাতে হবে।
দ্বিতীয় হুগলী সেতু পার হতেই কন্ডাক্টর টিকিটের বান্ডিল নিয়ে ভাড়া চাইতে হাজির।
বললাম একটা সত্তর দেবেন।
মানে? এটা কি লোকাল বাস পেয়েছেন? যাবেন কোথায়?
সত্তর টাকায় যেখানে নামা যাবে।
লোকটা কটমট করে আমার দিকে চেয়ে রইল। যেন পারলে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
লোকাল বাস হলে নামিয়েই দিত। তাদের সত্তর টাকার টিকিট হয়না। কিন্তু স্টেট-বাস তখন আশি নব্বইয়ে ছুটছে। আর কন্ডাক্টর আগেই বলেছে কোলাঘাটের আগে গাড়ি দাঁড়াবে না। অতএব বসে থাকা যায় নিশ্চিন্তে।
অতঃপর খানিক শাণিত দৃষ্টি বিনিময়ের শেষে কন্ডাক্টর সত্তর টাকার টিকিট কেটে আমাকে নন্দকুমার স্টপেজে নেমে যেতে বলল।
৩.
নন্দকুমার জায়গাটাও আমার চেনা নয়। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বাজারের কাছে তমলুক যাওয়ার বাসস্ট্যান্ড। তমলুক পৌঁছে নৌকা করে যেতে হবে মায়াচর।যেখানে নেমেছি সেখানে চারিদিকে রাস্তা আর রাস্তা। দোকানপাট নেই বিশেষ। বাজার কিছুটা দূরে ভিতরের দিকে।
হেঁটে বাজার পৌঁছে হঠাৎ মনে পড়ল এখানেই আমার কলেজ দিনের এক বান্ধবীর বাড়ি। দেখা নেই বেশ কিছু বছর। মাথায় শয়তানী বুদ্ধি খেলে গেল। তার বাড়ি গিয়ে তাকে চমকে দিয়ে তবেই অন্য কোথাও যাওয়া যাবে।
নন্দকুমার জুড়ে মাইতি, জানা আর সামন্তদের মধ্যে নীহারিকা সামন্তর বাড়ি ঠিক কোথায় তা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন কাজ। তবুও একটা ক্ষীণ আশা আছে। নীহারিকা ডাকসাইটে সুন্দরী। সুন্দরীদের অনেক ভক্ত থাকে। তবু ঠিকানা পাওয়া গেল না সহজে। শেষে এক লটারীওয়ালা বলল ঐতো যার বাবার ওষুধের দোকান সেই মেয়েটা? জানিনা, হতেও পারে। বললাম হ্যাঁ।
সেই দিক দিয়ে সোজা গিয়ে পুকুর ধারের শেষ ঘরটা।
লোকটা ভালো। রাস্তা বোঝাতে শূন্যে একটা ডবলু আকৃতির মানচিত্র এঁকে দেখিয়েও দিল। এর পরেও বুঝতে পারিনি কথাটা বলা যায়না। আন্দাজে সেই দিকের খোঁজ করতে করতে একটা পুকুর কিন্তু সত্যি পাওয়া গেল। এর শেষ বাড়িটা ওদের হলেই হয়।
৪.
পুকুরের ধারের শেষ যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে সেখানে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। একদল বাচ্চা সামনে খেলে বেড়াচ্ছে। অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়ার একটা সুবিধা আর একটা অসুবিধা থাকে। সুবিধা হলো অনেক লোকজনের মাঝে আলাদা করে কেউ খেয়াল করে না। অসুবিধা হলো বাড়ির বয়স্ক লোকরা যখন খেয়াল করে তখন নিজের আসার সূত্র বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়। কিন্তু এটাই যে সেই বাড়ি তা এখনও জানিনা। এক ভদ্রলোক খুব ব্যস্ত হয়ে সবদিক সামলাচ্ছে দেখে বুঝলাম ইনিই কর্তা। জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ। বাবলি উপরে আছে। সেই দিক দিয়ে সিঁড়ি। দেখা করে এসো।
এটা নীহারিকারই বাড়ি। নীহারিকার ডাকনাম বাবলি। কিন্তু এই নীহারিকাই সেই নীহারিকা কিনা দেখা না হলে বোঝা যাবে না। উপরে আসতে একজন বাবলিকে ডেকে দিল। তারপর ঘর থেকে যে বেরিয়ে এলো তাকে আমি চিনি।
নীহারিকা।
প্রত্যেক নারীরই রূপের নানা পর্যায় থাকে। ফ্রক পরে যখন সে স্কুলে যায় তখন তার এক রূপ। যখন সে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরে তখন আরেক। কলেজে সে আধুনিকা। এই সব রূপের মাঝেই অল্প বিস্তর ব্যবধান থাকে। শুধু বিয়ের দিন তার দুই রূপ দেখা যায়। সকালে বিয়ের ঠিক আগে একরকম আর বিয়ের সাজে আরেকরকম। বিয়ের আগে তাকে রাজকন্যার মত দেখায় আর বিয়ের সাজে রানীর মত।
হলদে শাড়িতে নীহারিকা বেরিয়ে এলো। দুহাত ভর্তি নানা রঙের চুরি। কব্জি ছাড়িয়ে ওঠা গাঢ় খয়েরি মেহেন্দির নকশা ওর ত্বককে আরও উজ্জ্বল করছে। ওর মুখে বিরক্তি নেই। বিস্ময় নেই। রাগও নেই। অপার প্রশান্তি আর নিশ্চয়তা যেন ওর থেকে আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে।
আমরা একটা সোফায় বসে অল্প কিছুক্ষণ কলেজের নানা তুচ্ছ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করলাম। তারপর ও আমাকে বলল - একটা কাজ করে দিবি?
কি?
আমার একটা ছোট্ট ক্যামেরা আছে। ওটা দিয়ে কিছু ভালো ছবি তুলে দিস।
এমন সুন্দরীদের একটা আদেশ পেয়ে আমি প্রাণ ত্যাগ করতেও রাজি। অনুরোধে গোটা কয়েক ছবি তুলতে পারব না?
দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে নামল। আলোয় আলোয় অনুষ্ঠান বাড়ি সেজে উঠল। উলুধ্বনি উঠল। বর এসেছে, বর এসেছে। আমি একটা ছোট্ট ক্যামেরা নিয়ে প্রতীক্ষায়। কখন বিয়ের সাজে নীহারিকা বেরিয়ে আসবে। রানীর মত সিংহাসনে বসবে। চোখ দিয়ে, ছোট্ট ক্যামেরার লেন্স দিয়ে কখন ওকে দেখব।
৫.
বিয়ে এক সময় ফুরিয়ে গেল। ভাড়া করা বড়বড় ক্যামেরাতে অনেক ছবি উঠল। আমিও ছোট্ট ক্যামেরা নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলাম।
পরের দিন ওর চলে যাওয়ার পালা। এক সময় সাজানো গাড়িতে নীহারিকা চলেও গেল। সুন্দরী মাত্রই নিষ্ঠুর হয়। ক্যামেরার কথা, ছবির কথা, এমনকি আমার কথাও ও জানতেও চাইল না। আমার খুবই অভিমান হলো। রাগে দুঃখে ক্যামেরাখানা ওর বাড়িতে রেখে মেমরি কার্ডটা পকেটে নিয়ে আমি বাস স্ট্যান্ডে ফিরলাম। কলকাতার বাসে সিটও পাওয়া গেল। কালকের রাত জাগা। কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে গেলাম।
তারপর দেখি বিরাট এক নদী। তার মাঝে সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আকাশে, জলে কেউ একমুঠো সিঁদুর ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই লাল রঙ ছুঁয়ে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে কোথাও। আমি এক নির্জন দ্বীপে বসে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছি। নদীর তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
মায়াচর...


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা