বাংলায় বর্গী হানা ও পলাশীর কিছু পুরনো কথা

এ ইতিহাস পলাশীর যুদ্ধের থেকেও প্রাচীন।
বাংলার মসনদে তখন সিরাজের দাদু আলীবর্দী খান। 
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র চলেছেন মুর্শিদাবাদ দরবারে। সঙ্গে কয়েক লক্ষ টাকা; নানা উপঢৌকন। নবাবের কাছে বার্ষিক খাজনা দিতে হবে। বিন্দুমাত্র দেরি হওয়ার জো নেই। ঠিক সময়ে না পৌঁছালে বড়সর বিপত্তি। প্রজাপালক হিসাবে অলিবর্দীর খুব নামডাক কিন্তু শাসক হিসাবে তিনি কড়া। একটু বেশিই কড়া। খাজনা দিতে দেরি হলে বা দেয় খাজনায় কোনোরকম অসঙ্গতি থাকলে নির্মম ভাবে হত্যা করতে তাঁর হাত কাঁপে না। অত্যাচারের বিভিন্ন পন্থা আছে। আম জনতার সামনে চরম হেনস্থা করে বিষ্ঠার পুকুরে ডুবিয়ে মারা হয়। 
যদিও রঘুনন্দন আঁটঘাট বেঁধে, পর্যাপ্ত সময় নিয়েই বেড়িয়েছেন কিন্তু পথের কথা কে বলতে পারে।
নদীয়ার গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে মুর্শিদাবাদের প্রায় উপকণ্ঠে পৌঁছেছেন তিনি। এবারে পার করবেন নদীয়ার শেষ গ্রাম পলাশী। রঘুনন্দন কিছুটা নিশ্চিন্ত। মুর্শিদাবাদ জেলায় ঢোকার পরে নবাব-দরবারে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। 
এমন সময় দূরে দেখা গেল কালো মেঘের মত একদল অশ্বারোহী। শ্রান্ত সৈনিকেরা নড়ে চড়ে উঠল। কিন্ত তারা বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই অশ্বারোহীর দল ঘিরে ফেলল তাদের। অসম লড়াইয়ে হার হলো নদীয়া রাজের সেনাদলের। বহু হতাহত হলো। কিন্তু সব থেকে বড় বিপদ হলো রঘুনন্দনের। তিনি প্রাণে বাঁচলেন বটে কিন্তু তার হেফাজতে থাকা নদীয়া রাজের কয়েক লক্ষ টাকা আর উপহার যা নবাব দরবারে পৌঁছানোর গুরুদ্বায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে, তার এক আনিও অবশিষ্ট রইল না। পলাশীর প্রান্তরে লুঠ হয়ে গেল নবাবকে দেয় খাজনার সমস্ত। 
রঘুনন্দন মিত্র পড়লেন দোটানায়। এ অবস্থায় তিনি না পারবেন কৃষ্ণনগর ফিরতে না মুর্শিদাবাদে যেতে। গেলেও তাঁর কথা বিশ্বাস করবে কে? কার এত সহজ হবে সৈন্য সামন্ত পরিবৃত নবাবের খাজনা লুঠ করার; তাও মুর্শিদাবাদের এত কাছে? 
রঘুনন্দন যদিও মুর্শিদাবাদের পথই ধরেছিলেন। হয়ত তাঁর আশা ছিল নবাব সৈন্য সামন্ত দিয়ে সাহায্য করবেন। লুঠের মাল উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু আসলে তা হয়নি। 
নবাবের দরবারে নদীয়ার দেওয়ানের উপর নেমে আসে চরম শাস্তি। অলিবর্দীর আদেশে তাঁর দেওয়ান মানিকচাঁদ রঘুনন্দন মিশ্রকে প্রথমে গাধার পিঠে চাপিয়ে গোটা শহর ঘোরান, তারপর কামানের সামনে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে নিষ্ঠুর হত্যা করা হয় রঘুনন্দন মিশ্রকে।

কিন্তু করা এই লুঠেরা যারা এত দুঃসাহস দেখতে পারে। কৃষ্ণচন্দ্রের সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলা করে এমন নিপুন ভাবে লুন্ঠন যারা করেছিল তারা বাংলার ত্রাস মারাঠি দস্যুর দল। তারা বর্গী। পলাশীতে বর্গীদের একটা বড়সড় ঘাঁটির কথা জানা যায় ইতিহাস থেকে। পলাশী থেকেই নদী ও স্থলপথে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের নানা এলাকায় লুঠপাট চালাত বর্গীদের সেই দল।
১৭৪৪ সালের কথা। পলাশী থেকে ৩০ কিমি দূরে মুর্শিদাবাদের মানকড়া গ্রামে একটি চমৎকার তাঁবু খাটানো হয়েছে। তার ভেতরে অপেক্ষা করছেন নবাব আলীবর্দী স্বয়ং। দেখা করতে আসবেন পেশোয়ার প্রধানমন্ত্রী ও বর্গীদের সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত। সন্ধি হবে। নবাব আসার আগেই মারাঠারা দেখে গেছে তাঁবুর ভেতরে কেউ নেই। কথা হবে নবাব আর ভাস্কর পন্ডিতের। তাঁকে ঢুকতে দেখে নবাব আপ্যায়ন করে ভেতরে আনলেন। দু একটা মামুলি কথা বার্তা চলতে না চলতেই তাঁবুর কাপড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল নবাবের কিছু সৈন্য আর ঘাতক মুস্তাফা খান। এক কোপে ধর থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেওয়া হলো ভাস্কর পন্ডিত আর তার সহচরদের। কিন্তু তারপরেও বাংলায় বর্গী আক্রমণ থেমে থাকেনি। শেষে ১৭৫১ সালে চুক্তি হয় মারাঠা দস্যুরা আর সুবর্নরেখা অতিক্রম করবে না তার বদলে তাদের উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দিতে হয় আলীবর্দীকে।
বাংলায় বর্গী আক্রমণ ও নৃশংসতার প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায় গঙ্গারাম রচিত "মহারাষ্ট্র পুরান" পুঁথিতে। এছাড়াও এই বর্গীদের অত্যাচারের কথা লিখে গেছেন রায়গুণাকর ভরতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গলে। 
বর্গীরা শুধু লুঠতরাজ করেই ক্ষান্ত হতো না। বিপুল অত্যাচার আর ধ্বংস না করলে তারা যেন শান্তি পেত না।
তারা ছিল শক্তি সাধক। ভবানীর উপাসক। শুধু ঘর বাড়ি, গ্রাম নগর ধ্বংস নয় তারা বাংলার বহু চারচালা বিষ্ণু মন্দির ধ্বংস করেছিল। কৃষি নির্ভর বাংলা বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বর্গী আক্রমণের ফলে। প্রাণভয়ে গ্রামছাড়া হয়েছিলেন শান্তিপুর ফুলিয়ার তাঁতিরা ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল বাংলার বস্ত্রশিল্পে। 
বর্গীর ভয়ে ভাগীরথীর কূল ছেড়ে পলাশী গ্রামের বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছিল জলঙ্গির তীরে। কিন্তু ফেলে আসা গ্রামকে তারা ভুলতে পারেনি। জলঙ্গীর পাড়ে তাদের তৈরি নতুন জনপদের নাম হয়েছিল পলাশীপাড়া।
বর্গীর অত্যাচার বাংলা আর বাঙালীর জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আজো তাই বাংলার ঘুমপাড়ানি গানে বর্গী আক্রমণের কথা শোনা যায়।





তথ্যসূত্র: নদীয়ার স্থাননাম- মোহিত রায়
এবং
www.prohor.in

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (দ্বিতীয় পর্ব)

পরিমল ভট্টাচার্য ও আমরা (প্রথম পর্ব)

কোরকের কথা